একজন কবি কি আছেন বাংলা ভাষায়, বাংলা সাহিত্যে, যিনি বর্ষা কিংবা বৃষ্টি কিংবা মেঘ নিয়ে কবিতা লেখেননি? মেঘ, বৃষ্টিতে ভরপুর আমাদের বাংলা সাহিত্য। সেই প্রাচীন সংস্কৃত, মৈথিলি ভাষাতেও আমরা দেখি শ্রাবণ মেঘের ধারা। কালিদাসের মেঘদূত, চণ্ডিদাস, বিদ্যাপতির পদাবলিতে বহুই ভিজেছি আমরা। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে নজরুল, জীবনানন্দ, জসীমউদ্দীন, শক্তি, সুনীল, শামসুর রাহমান, আবুল হাসান- সকল কবিই বারিধারায় মোহিত। বাংলা সাহিত্যে বর্ষা-বৃষ্টির প্রভাব নিয়ে লিখতে গেলে, শুধু বৃষ্টির কবিতা নিয়েই লিখতে গেলে একাধিক ঢাউস বই হয়। রবীন্দ্রনাথ একাই বিপুল বৃষ্টির নিশানা রেখে গেছেন, আর গল্প-কবিতা-প্রবন্ধে, চিঠিপত্রেও। বাংলায় বৃষ্টির কবিতা পড়তে পড়তেই একদিন মনে কৌত‚হল জাগল, ভিন্ন দেশের ভিন্ন ভাষার কবিরা বৃষ্টিকে কী চোখে দেখেন। সেই কৌত‚হলেরই ফসল এই বই। বৃষ্টিকে খুব ভালো চোখে দেখে না, পাশ্চাত্যের সাধারণ মানুষ, শীতের দেশের মানুষ তারা। তাদের প্রিয় হলো সামার বা গ্রীষ্মকাল। কখনো বা বৃষ্টি একটা খারাপ আবহাওয়া অনেক দেশেই। কিন্তু কবিরা কোনো দেশেই কোনোভাবেই আবহাওয়াবিদ নন। তাদের মনোজগৎ বৃষ্টির মতোই বিবিধ সুরে সঞ্চারিত। কবিদের বৃষ্টি দেখার ভঙ্গি মানচিত্র ভেদে ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু বৃষ্টি উদ্যাপন তো কম-বেশি সব সংবেদনশীল মানুষই করে থাকেন। এই অনুবাদ কবিতাসমূহ প্রমাণ করবে, বৃষ্টির প্রতি টান, আবেগ, ভালোবাসা, কখনো অভিমান বিবিধ দেশেও কম নয়। আর বৃষ্টির সঙ্গে যোগ হয়েছে মেঘ-বন্দনাও। মেঘের রং-রূপ তো কম নয়। বৃষ্টির আগে মেঘ যেন সঙ্গমের আগে শৃঙ্গার। ভ্যাস্লাভা শিম্বোরাসকা লিখেছেন- ‘তাদের ট্রেডমার্কই হলো : তারা কোনোভাবেই পুনরাবৃত্তি করে না আকার, রং, ভঙ্গি, আয়োজনের।’ নানা দেশের নানা ভাষার অর্ধশতাধিক কবিতা আমি নির্বাচন করেছি, অনুবাদ করেছি, প্রয়োজনে কবিতার সঙ্গে ঠীকা-টিপ্পনীও সংযুক্ত করেছি। আর প্রতিটির কবিতার সঙ্গে অতি সংক্ষেপে কবি পরিচিতি দিয়েছি। এতে করে বাংলার পাঠক বৃষ্টির কবিতার পাশাপাশি কবিদের সঙ্গেও পরিচিত হতে পারবেন। কবিতা ও কবি নির্বাচনে আমি চেষ্টা করেছি বৈচিত্র্য রাখতে। এই বৈচিত্র্য বক্তব্যেরও। বৃষ্টিকে কত বিচিত্রভাবেই না দেখেছেন বিশ্বের কবিরা! চার্লস বুকুস্কি লিখেছেন বৃষ্টি নিয়ে দীর্ঘ কবিতা। বারো পাতার এই দীর্ঘ কবিতায় একটা উপন্যাসের উপাদান রয়েছে। অন্যদিকে মাত্র তিন লাইনের হাইকু রচনা করে কোবাইয়াশি ইশা একটা চকিত চমক দেখিয়েছেন। জাপানি হাইকু মূলত ঋতু আর প্রকৃতিকে তুলে ধরে। সেই বিবেচনায় বর্ষাকাল যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে হাইকুতে। এ সংকলনে আমি বেশ কিছু হাইকু রেখেছে। তারপর জাপানি হাইকু থেকে বৃষ্টিতে তুলে আনতে গেলে পুরো একটি বই তৈরি করতে হয়, সে সুযোগ এখানে নেই। একই ঘরানার বা একই ধরেনের অধিক কবিতা এখানে আমি এড়িয়ে চলেছি। পাঠককে একঘেয়েমিতে ফেলে দেয়া আমার কাজ নয়। আমি বরং বৈচিত্র্য আনতেই চেয়েছি। কত বিচিত্রভাবেই না মেঘ-বৃষ্টিকে দেখেছেন পৃথিবীর নানা দেশের কবিরা! পাপুয়া নিউ গিনির কবি কুমালাউ তাভালি বৃষ্টি নিয়ে বলছেন, ‘দেবদূতেরা মূত্র ত্যাগ করছে।’ অন্যদিকে মার্কিন কবি নিকি জিওভান্নি বলছেন, ‘বৃষ্টি হলো/ দেবতার পতনশীল শুক্রাণু’। সারা টেয়াসডালে কিংবা ইহুদি আমেচাই যুদ্ধের ময়দানে বৃষ্টিপাত দেখেছেন। এই সংকলনের জন্য ইউরোপ, এশিয়া, আমেরিকা, ল্যাটিন আমেরিকার কবিদের কবিতা অনুবাদ করেছি আমি। আমারই সীমাবদ্ধতার কারণে আফ্রিকার কবিতা এখানে সংযুক্ত করতে পারিনি। আফ্রিকার কবিতার তেমন সংকলন আমার হাতে নেই এবং নেটে ঘেঁটেও আফ্রিকার বৃষ্টির কবিতা বের করতে পারিনি। এ জন্য আমি ক্ষমাপ্রাথী। মনে সান্ত¡না এই যে, পরবর্তী সংস্করণে আফ্রিকার বৃষ্টির কবিতাও যোগ করে দিতে পারব। কবি নির্বাচনে উইলিয়াম শেকসপিয়ার থেকে বব ডিলান পর্যন্ত নিজেকে বিস্তৃত করেছি আমি। তবে কবিতা সাজানোর ক্ষেত্রে সময়কালকে গুরুত্ব দিতে পারলে ভালো হতো। আফসোস, আমাদের সময় বড় কম। কথা দিচ্ছি, যদি পরবর্তী সংস্করণে কবিতাগুলো সাজিয়ে দেব সময়ক্রম নিয়ে। তবে এই এলোমেলো বৃষ্টির ছাঁটটিও পাঠকের মন্দ লাগবে না বলে মনে করি। পাঠক, বিদেশি বৃষ্টিতে ভেজার আমন্ত্রণ। সাথে কিছু মেঘও উপহার হিসেবে রইল। মুম রহমান, প্রকল্প পরিচালক, ক্রিয়েটিভ ঢাকা
মুম রহমান। পুরাে নাম মুহম্মদ মজিবুর রহমান। জন্ম ২৭ মার্চ, ১৯৭১ সাল। বাবা : মাে. মুসলেহ উদ্দিন। মা : তাহেরুন্নেসা। দেশে এবং দেশের বাইরে উল্লেখযােগ্য পত্র-পত্রিকায় অসংখ্য গল্প-উপন্যাস-নাটক-প্রবন্ধ-অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি ব্যস্ত টিভি নাটক আর বিজ্ঞাপনের স্ক্রিপ্ট নিয়ে। প্রথম রচিত ও অভিনীত টিভি নাটক এক চিলতে আকাশ ১৯৮৮ সালে বিটিভিতে প্রচারিত । কাজ করেছেন মঞ্চ ও বেতারে। নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ থেকে নাট্য রচনায় এমএ । পত্র-পত্রিকা ও বিজ্ঞাপনী সংস্থায়ও কর্মরত ছিলেন । বর্তমানে ইংরেজি মাধ্যমের এক স্কুলে নাট্যশিক্ষক হিসাবে কর্মরত। সাকিরা পারভীনকে নিয়ে তৈরি করেছেন আর্ট জোন নামের সংস্থা; যেখানে নাট্যরচনা, আবৃত্তি, বনসাই তৈরির মতাে বিষয়ে ভিন্ন ধারার প্রশিক্ষণ কোর্স পরিচালনা করেন তিনি।