আমি কাজ করি শব্দ নিয়ে। কিন্তু আমি জানি, শব্দের চেয়ে ছবির গতি ও জোর অনেক বেশি। শব্দের সীমাবদ্ধতা হলো তাকে পড়তে হয়, বুঝতে হয়, একটা নির্দিষ্ট ভাষার প্রকরণ আর ব্যাকরণ মেনে। কিন্তু ছবির ভাষা বৈশ্বিক। আমার প্রিয় একজন আলোকচিত্রকর এলিয়ট এর্ভিট বলেন, ‘ছবি তোলার পুরো বিষয়টি হলো আপনাকে শব্দ দিয়ে আর কিছু ব্যাখ্যা করতে হচ্ছে না।’ ছবি আদতেই শব্দের ব্যাখ্যার অতীত। ভাষাগত মাধ্যমের সঙ্গে তুলনা করলে শিল্পের জগতে চিত্রকর্ম হলো কবিতার মতো। সে যত না প্রকাশ করে, তার চেয়ে বেশি রহস্য বুনে রাখে। আর দ্রষ্টার ভেতরে ক্রমশ স্রষ্টা ও তার সৃষ্টিকর্ম ঢুকে যেতে থাকে। চিত্র, তা তৈলচিত্রই হোক আর আলোকচিত্রই হোক, তা যোগ্য শিল্পীর হাতে হয়ে ওঠে রহস্য—রোমাঞ্চের কারখানা। এইসব কথাই আমার মনে পড়ে, বন্ধু আবিদ এ আজাদের আলোকচিত্র দেখতে গেলে। তার অসংখ্য আলোকচিত্র দেখার সুযোগ আমার হয়েছে এবং তার চেয়ে সৌভাগ্যের কথা তার অসংখ্য আলোকচিত্র নির্মাণ হওয়ার প্রক্রিয়াটি আমি দেখেছি। হয়তো একসাথে কোথাও গেছি, বসে আছি একসাথে কিংবা হাঁটছি, হুট করে আজাদ একটা ছবি তুলে ফেলল। সেই ‘হুট’ করে শাটারের খুট হওয়ার পরই যেন ঘটনাটি, বিষয়টি আমার চোখে পড়ল। কিংবা চোখে পড়তে বাধ্য হলো। কোথাও কয়েকটা মরা পাতা পড়ে আছে, কোথাও একটা ইটের দেয়াল বেয়ে একটা গাছ, কোথাও পুরনো ভাঙা দেয়ালে শ্যাওলা, কোথাও একটা জমিনে ফাটল, কোথাও গাছের শরীর, কোথাও টেবিলের ওপর রাখা শুকিয়ে যাওয়া কলা, কোথাও একগাদা কাগজের স্তূপÑ কী যে তার ক্যামেরায় উঠে আসে তা এক বিস্ময়। আমরা হেঁটে যাব, বসে রইব, তাকিয়ে থাকব, কিন্তু দেখব না যে জিনিস সেটাই আজাদের চোখে ধরা পড়ে। আমার দীর্ঘকালের পর্যবেক্ষণ থেকে দেখেছি, মূলত জমিনের মধ্যে রং—রেখার খেলা, আলো—ছায়ার নখরামি ধরা পড়ে ওর চোখে। চোখ তো নয়, যেন শকুনের কর্ণিয়া পেয়েছে ও। মেগাপিক্সেলের হিসেবে ওর ছবিকে মাপা যায় না। আজাদ ছবি তোলে মগজ দিয়ে। একটা অঙ্কের জাদু, নকশার কেরামতি তার ছবির মূল বিবেচ্য। আরেকটা বড় কুদরতি কারবার হলো, কথিত সুন্দরের দিকে তার টান নেই। সুন্দর একটা ফুল, পাখি, প্রাকৃতিক দৃশ্য, নারীর মুখ এইসবের দিকে ওকে তাকাতে কম দেখেছি আমি। ওর সব মায়া যেন জগতের সব মরা, পরিত্যক্ত, পুরনো, বাতিল, বাজে জিনিসের প্রতি। যেখানেই একটু শ্যাওলা পড়েছে, রং উঠে গেছে, দাগ পড়েছে সেখানেই আজাদ দাঁড়িয়ে যায়। তুলে ফেলে নান্দনিক একটা ছবি। এই তুলে ফেলাটা সত্যিই হুট করে, খুট করে তুলে ফেলা। এত দ্রুততায় আজাদ ছবি তোলে কখনো মাছরাঙাও মনে হয় ওকে। টুক করে ডুব দিয়ে জলের তলা থেকে প্রাণ তুলে আনার মতো আজাদও পারে হুট করে অবস্তুকে প্রাণ দিতে। তখনো আমার এলিয়ট এর্ভিটের কথাই মনে পড়ে আবার। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার কাছে, আলোকচিত্র হলো পর্যবেক্ষণের শিল্প। এটা হলো সাধারণ কোনো স্থানে মজাদার কিছু খুঁজে পাওয়া...আমি দেখেছি যে আপনি কী দেখছেন এর সঙ্গে এটার সম্পর্ক নেই বরং কীভাবে এগুলোকে দেখছেন তার ওপরেই সবটা নির্ভর করে।’ আমি ঠিক জানি না, জিজ্ঞেস করা হয়নি আজাদকে সে এলিয়ট এর্ভিটের কথা পড়েছেন কি না। সম্ভবত পড়েননি। তাকে পড়তে কমই দেখেছি। কিন্তু তাতে কিছু যায়—আসে না। বই পড়ার চেয়েও সে অনেক বেশি জগতের আলো—অন্ধকারকে পড়তে শিখেছে। সে বড় সহজ কথা নয়। এমন তো বলা হয়, মহৎ মানুষেরা একভাবেই চিন্তা করে। নইলে এর্ভিটের সঙ্গে আজাদের মিল কীভাবে পাই! কী দেখছি, তার চেয়েও কীভাবে দেখছি সেইটাকে বড় করে দেখতে শিখেছেন, শিখেয়েছেন দুজনেই। লেখাটা শেষ করি, আজাদের একটু দুর্নামগাথা দিয়ে। বইপত্রের ভূমিকা টুমিকায় নিয়ম হলো, ভালো ভালো কথা লেখা, একচেটিয়া প্রশংসা করা। আমি নিয়ম না—মানা লোক এবং হুটহাট সত্যি কথা বলার অভ্যাস রাখি। আশা করি আজাদ আমাকে এ বিষয়ে ক্ষমা করবেন। আজাদের সবচেয়ে বড় দোষ হলো, তার বিবিধ ব্যাবসায়িক প্রকল্প। এইসব প্রকল্প নিয়ে সে এত ব্যস্ত থাকে যে, ছবি তোলার জন্য সে আলাদা সময় রাখে না। নিজের যে সহজাত প্রতিভা আর একদার পরিশ্রমলব্ধ জ্ঞান মিলিয়ে সে ছবি তুলে যাচ্ছে। কিন্তু যত ছবি তোলে তার অধিকাংশই হারিয়ে যায়, ব্যস্ততার অতলগহ্বরে। মোবাইল বদল হয়, ক্যামেরা বদল হয়, হার্ডড্রাইভ বদল হয়, কম্পিউটার বদল হয়Ñআর এত সব বদলের ভিড়ে আজাদের ছবিও নিয়মিত কিছু কিছু করে খোয়া যায়। তাতে আজাদের হয়তো ক্ষতি হয় না, কিন্তু আমরা একটা ধারাবাহিক শিল্প—যাত্রা দেখা থেকে বঞ্চিত হই। সে যতটুকু নিয়মিতই ছবি তোলে তার চেয়ে অত্যধিক অনিয়ম করে ছবি প্রকাশের ব্যাপারে। আমার জানা মতে, তার কোনো ফটোগ্রাফিক এক্সিবেশন হয়নি। হওয়া উচিত ছিল অনেক আগেই। ইতোপূর্বে প্রায় জোর করে ওর তোলা সমুদ্রের কিছু ছবি আমরা পেয়েছি। সেই বইতেও ওর ছবিগুলোর জন্য আমি কিছু কবিতা লিখেছিলাম, কখনো বা আমার কিছু কবিতার জন্যই ও ছবি তুলেছিল। কিন্তু সেই বইটা আকারে বড় ক্ষুদ্র। গত কয়েক বছরের ধারাবাহিক চাপ আর রাগারাগির ফলে এবারের এই বইটা প্রকাশ হতে যাচ্ছে। আমি এখানে প্রকাশ্যে জানিয়ে রাখি, প্রিয় পাঠক আপনারা আজাদকে চাপ দিন। সরাসরি, ই—মেইলে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ওকে একটা চাপের মধ্যে রাখুন। আমি জানি, চাপের মুখে পড়লে এই অলস (অথবা জাগতিক আয়—ইনকামে অতি ব্যস্ত) লোকটির আরো আরো ছবি আমরা দেখতে পারব। ভালো জিনিস দেখার অধিকার আমাদের আছে। তাই না প্রিয় পাঠক? এইবার শেষ করি নিজের কথা দিয়ে। অনেকটা লিমিরিক আঙ্গিকে আজাদের ছবির সঙ্গে আমি পাঁচ লাইনের কিছু কবিতা সংযোজন করেছি। আপনাদের স্পষ্টতই জানিয়ে দিই, আজাদের ছবির ক্যাপশন এগুলো নয়। কোনোভাবেই এগুলোর লেখার আগে বা পরে আমি আজাদের সঙ্গে ওর তোলা ছবি নিয়ে আলোচনাও করিনি। আমি বরং একধরনের স্বতঃস্ফূর্ততায় এই কবিতাগুলো লেখেছি। যে ছবিটি দেখে আমার মাথায় যখন যে লাইনগুলো এসেছে আমি তাই করেছি। কাজেই আমার লাইনগুলোকে এই ছবি অনুধাবনের সূত্র বা ইশারা মনে করলে হবে না। এগুলো একান্তই আমার অনুভূতি, ছবি দেখার অনুভূতি। আমি বিশ্বাস করি, পাঠক ও দর্শক, স্বয়ং আজাদের একেকটি ছবির প্রেক্ষিতে নিজের মতো করে অসংখ্য শব্দ, বাক্য, লাইনের দিকে এগোবেন। অতএব, কেউ চাইলেই সচেতনভাবে আজাদের ছবিগুলো শুধু দেখতে পারেন এবং আমার লাইনগুলো এড়িয়ে যেতে পারেন, তাতে লাভবানই হবেন বলে আশা রাখি। এলিয়ট এর্ভিটের ৯৩ বছর বয়সে এখনো ছবি তুলে যাচ্ছেন, তার আলোকচিত্র নিয়ে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৪৩। আজাদ তো বয়সের হিসেবে এর্ভিটের অর্ধেক আর কাজের তুলনায় কেবল সূচনাকারী। তবু আমি প্রত্যাশা করি, প্রার্থনা করি আজাদ বড় একটা কর্মক্ষম আয়ুরেখা ছুঁয়ে ফেলবে এবং একদিন তারও আলোকচিত্র বিষয়ক অনেকগুলো বই থাকবে। হয়তো এই বাংলাদেশের মানুষ একদিন আবিদ এ আজাদকে তার আলোকচিত্রের জন্য মনে রাখবে? মানুষ মানুষকে মনে রাখবে, এর চেয়ে মধুরতর আর কী হতে পারে। প্রিয় পাঠক, আজাদের আলোকচিত্র জগতে আপনাদের স্বাগত জানাই। শুভেচ্ছা, মুম রহমান
আবিদ আজাদ ১৯৫২ সালের ১৬ নভেম্বর কিশোরগঞ্জের চিকনির চর নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। স্থানীয় আজিমউদ্দিন হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং গুরুদয়াল কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। স্নাতক লাভ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পেশা: সাংবাদিকতা ও প্রকাশনা ব্যবসা। 'ঘাসের ঘটনা' (১৯৭৬) তাঁর প্রথম কাব্য। এরপর বেরিয়েছে আরো চৌদ্দটি কাব্য। কবিতার পাশাপাশি তিনি উপন্যাসসহ নানা ধরনের গদ্য লিখেছেন। উপন্যাসের সংখ্যা পাঁচটি, আত্মস্মৃতি একটি। তিনি 'শিল্পতরু' নামে একটি মাসিক সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। এছাড়াও তাঁর কয়েকটি কাব্যনাটক ও বেতার-টিভি নাটক রয়েছে। উল্লেখযোগ্য পুরস্কার বঙ্গবন্ধু পুরস্কার (১৯৭৬), চারণ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৬), আবুল হাসান স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮৯), মাইকেল মধুসূদন একাডেমী পুরস্কার, সা'দত আলি আখন্দ সাহিত্য পুরস্কার (২০১৮)। দেশ-বিদেশের পদক-সম্মাননাও পেয়েছেন বেশ কয়েকটি। আবিদ আজাদের প্রয়াণ ঘটে ২০০৫ সালের ২২ মার্চ।