ফ্ল্যাপে লিখা কথা নক্সী কাঁথার মাঠ ও সোজন বাদিয়ার ঘাট- এর মতো মহাকাব্য গাথা স্রষ্টা কবি জসীম উদ্দীরেন অসাধারণ কথাসাহিত্য ‘বোবা কাহিনী’। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাংলাদেশের কৃষক ক্ষেতমজুরের অর্থনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক জীবনের চরম দুর্দশা ও তার বিরুদ্ধে দুই প্রজন্মের লড়াই। নিঃস্ব দুঃস্থ কৃষিজীবী আজাহের ক্ষেতমজুর দশায়; নিজের শ্রমে-ঘামে যুদ্ধ করে যায় আরো বেশী ফসল ফলিয়ে নিজের ভাগ্য বদলের, সম্পন্ন কৃষক হবার। কিন্তু তার স্বপ্ন আর সম্ভব হয় না; তার পরের প্রজন্ম বছির লড়ে যায় শিক্ষাদীক্ষা লাভ করে তথাকথিত অবস্থাপন্ন বা ভদ্রগোষ্ঠীর স্বাছন্দ্য আনয়নে; বছিরের স্বপ্ন তার নিজের পরিবারের এবং পুরো্ গ্রামের মানুষের আর্থিক দুর্গতি মুক্তির।
গ্রামীণ জীবনের হৃদয় ছোঁয়া ভাষায় লেখক জীবনযুদ্ধের গাথা তুলে এনেছেন, তা সাধারণ স্বাক্ষর পাঠক থেকে উচ্চশিক্ষিত বোদ্ধা পাঠককে একই ভাবে আটকে দেবে উপন্যাসটির শুরু থেকে শেষ বাক্যটি পর্যন্ত। ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী শক্তির বিদায়ঘন্টা বেজে গেছে; সেই সময়কালের সুদখোর মহাজনদের , গ্রামীণ হাতুড়ে ডাক্তারদের , শহুরে আইনজীবী, মৌলবাদী ধর্মব্যবসায়ী ও পীরতন্ত্রের এবং সর্বোপরি জমিদার ভূস্বামীদের শোষণ-যাঁতাকল দরিদ্র কৃষক প্রজাকুলের ওপর কতোটা নির্মম স্টীমরোলার চালিয়েছে তার অনুপুঙ্খ বর্ণনা ওঠে এসেছে এই গল্পে। দরিদ্র ক্ষেতমজুর আজাহরে তার স্ত্রীকে প্রান্তিক কৃষকে উত্তীর্ণ করার লড়াই চালিয়ে গেছে-প্রচন্ড প্রতিকুল সমাজে ফসল ফলানো প্রানান্ত প্রয়াসে।
গ্রামীন হাতুড়ে ডাক্তারদের শাইলকসম চিকিৎসা ব্যবসায়ে ও ভুল চিকিৎসায় তাদের প্রাণপ্রিয় কন্যাসন্তান বড়ুর মৃত্যু ঘটে কলেরায়। তাদের পরের প্রজন্ম বছির বাবা-মায়ের জীবনযুদ্ধ থেকে উদ্ধুদ্ধ হয়ে শিক্ষাদীক্ষা লাভে এগিয়ে যায়, সে গ্রামীণ মানুষের ম্যালেরিয়া, কলেরা প্রভৃতি রোগে অসহায় মৃত্যুর অবসান ঘটাতে চায়, সর্বহারা দিনযাপনের গ্লানির মধ্যেও লেখাপড়া চালিয়ে উন্নত বিশ্বে জীবানুতত্ব শিক্ষা লাভের সুযোগ খুঁজে পায়; কিন্তু তার জন্য বছর বছর অপেক্ষায় থাকা নিজের ভালোলাগার মানুষ ফুলিকে নিষ্ঠুরতায় প্রত্যাখ্যান করে যেতে হয় তাকে। এই ট্র্যাজেডী এই দেশের জীবনসংগ্রামরত দারিদ্রপীড়িত মানুষের প্রতিদিনের গল্প। এই কাহিনী প্রতিটি পাঠকের নিজের জীবনের গল্প রূপে ধরা দেবে।
কবি জসীম উদ্দীন ১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। পার্শ্ববর্তী গোবিন্দপুর গ্রামের পৈতৃক বাড়িতে তাঁর শৈশব কাটে। তাঁর পিতা আনসার উদ্দীন সেখানে একজন স্কুল শিক্ষক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। তিনি এলাকায় প্রেসিডেন্টও ছিলেন। কবির মাতা রাঙাছুটু ছিলেন একনজন গৃহবধূ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা সাহিত্যে মাস্টার্স ডিগ্রী অধ্যয়নকালে ও লাভের পর জসীম উদ্দীন প্রখ্যাত পণ্ডিত ড. দীনেশচন্দ্র সেনের তত্ত্বাবধানে ‘রিসার্চ ফেলো’ পদে কর্মরত ছিলেন । দীনেশ সেন সেই দিনগুলোতে বাংলাদেশের বিভিন্ন পল্লী এলাকার মানুষের মুখে গীত-পঠিত পুথি সংগ্রহ ও গবেষণা করতেন । ড. সেন তার উপযুক্ত শিষ্য জসীম উদ্দীনকে বাংলার জেলাগুলোর বিশেষভাবে ফরিদপুর ও ময়মনসিংহ জেলার সেইসব পুঁথি (কাব্য-লোকগাথা) সংগ্রহের দায়িত্ব দেন। জসীম উদদীন পুথি সংগ্ৰহকালে গ্রামীণ জনগণের আনন্দ-বেদনার কাব্যগাথার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হন, মানুষকে ভালোবেসে একজন খাটি মানবপ্ৰেমী হয়ে ওঠেন। কবি পালাগান, গাজীর গান, জারীগান, লোকগীতির আসরে যেতেন, উপভোগ করতেন, মাঝে মাঝে নিজের বাড়িতেও লোকসঙ্গীতের আসরের আয়োজন করতেন । লোকগীতিতে সুরারোপ করেন ও বিশিষ্ট শিল্পীদের গান শেখান এবং পরবর্তীকালে কিছুকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেন । লোকসংস্কৃতির উপাদান প্রত্যক্ষ করেন। জসীম উদদীন কবিতা, নাটক, উপন্যাস, কাব্যোপন্যাস, প্ৰবন্ধ, ত্য গবেষণাগ্রন্থ, গান, ভ্রমণকাহিনী এবং ও স্মৃতিকথাসহ অর্ধশতাধিক বইয়ের রচয়িতা। কবি দুইবার এডিনবাৰ্গ উৎসবে (১৯৫০ ও ১৯৬২ সালে) এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ভয়াসহ বহু দেশে অনেক লোকসংস্কৃতি উৎসবে অংশগ্রহণ করেন। তাঁর গ্রন্থগুলো বিশ্বের বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে : ১৯৭০ সালে UNESCO তাঁর “সৌজন ব্যাদিয়ার ঘাট” ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ ও প্ৰকাশ করে । কবির ’মাটির কান্না’ কাব্যগ্রন্থটি রুশ ভাষায় একটি সংস্করণ বেরিয়েছে। ১৯৭৬ সালের ১৪ মার্চ কবি ইহলোক ত্যাগ করেন ।