"সোজন বাদিয়ার ঘাট" বইটির ফ্ল্যাপের অংশ থেকে নেয়া: ‘সােজন বাদিয়ার ঘাট' কাব্যোপন্যাসটি জসীম উদ্দীনের সেরা বহুলপঠিত বই। ১৯৩৩ সালে কবির মাত্র তিরিশ বছর বয়সে লেখা এই বইটি বাংলা কাব্যোপন্যাসের জগতে বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। ‘সােজন বাদিয়ার ঘাট' সর্বাধিক বিদেশী ভাষায় অনূদিত বাংলা বই। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “তােমার ‘সােজন বাদিয়ার ঘাট” অতীব প্রশংসার যােগ্য। এ বই যে বাংলার পাঠক সমাজে আদৃত হবে, সে বিষয়ে আমার লেশমাত্র সন্দেহ নেই।” মুসলমান চাষীর ছেলে সােজন আর নমুর মেয়ে দুলীর অপূর্ব প্রেমকাহিনী। তার সঙ্গে বিগত সামন্ত যুগের জমিদারী প্রথার নিষ্ঠুরতার আলেখ্য। নমুমুসলমানের দাঙ্গা-ঝন্ ঝন্ ঝন্ কাইজার থালা বাজিল। অন্ধকার রাতে দুলালীকে সঙ্গে নিয়ে সােজনের পলায়ন, গড়াই নদীর তীরে পাখির মত সােজন-দুলীর নীড় রচনা, তারপর সােজনের বিচার...দুলীর অন্যত্র বিবাহ। জেল থেকে ফিরে বেদের ঝালি মাথায় নিয়ে দেশে দেশে সােজনের দুলীর অন্বেষণ, নানা ঘটনাবৈচিত্র্যের মধ্য দিয়ে সােজন বাদিয়ার ঘাটে এনে কবি এই কাব্যের পরিসমাপ্তি ঘটান। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একজন পন্ডিত চেকোশ্লাভাকিয়ার ভাষাবিদ প্রফেসর ডঃ দূশন জুভিতেল জসীম উদ্দীন সম্পর্কে বলেন, “...জসীম উদ্দীনের বই যখন পড়ি তখনই তাতে নতুন নতুন সৌন্দর্য আবিষ্কার করি। ...কবি জসীম উদ্দীন ... এইসব গ্রাম্য সাহিত্য ঘনিষ্ঠভাবে চেনেন, লম্বা লম্বা বছর ধরে নিজেই গ্রাম্য গান সংগ্রহ করেছিলেন। উনি কবি, বাল্যকাল থেকে কবিশিষ্যের মত সবচেয়ে বড় কবির পায়ে বসেছিলেন যার নাম হচ্ছে জনসাধারণ। আমার বিশ্বাস ওর থেকে উনি তার নকশী কাঁথার মাঠ', সােজন বাদিয়ার ঘাট’ ‘সকিনা ইত্যাদি বইগুলির বাইরের রূপ পেয়েছেন, গ্রাম্য কবিদের সঙ্গে একই অতল সৌন্দর্যের সাগর থেকে পান করতে শিখেছেন।... জনসাধারণের প্রতি জসীম উদ্দীনের অপরিসীম মমতা ও সমবেদনাবােধ যাকে বলা যায় Poetic Humanism. ... উনি তাে গ্রামের মানুষ, মাটির মানুষ, বাংলা জনসাধারণের সঙ্গে অসংখ্য বন্ধন দিয়ে বাঁধা কবি। তাদের সুখ দুঃখ বুঝতে পারেন, তাদের আনন্দ-বেদনা মুখরিত করতে জানেন।”
কবি জসীম উদ্দীন ১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। পার্শ্ববর্তী গোবিন্দপুর গ্রামের পৈতৃক বাড়িতে তাঁর শৈশব কাটে। তাঁর পিতা আনসার উদ্দীন সেখানে একজন স্কুল শিক্ষক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। তিনি এলাকায় প্রেসিডেন্টও ছিলেন। কবির মাতা রাঙাছুটু ছিলেন একনজন গৃহবধূ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা সাহিত্যে মাস্টার্স ডিগ্রী অধ্যয়নকালে ও লাভের পর জসীম উদ্দীন প্রখ্যাত পণ্ডিত ড. দীনেশচন্দ্র সেনের তত্ত্বাবধানে ‘রিসার্চ ফেলো’ পদে কর্মরত ছিলেন । দীনেশ সেন সেই দিনগুলোতে বাংলাদেশের বিভিন্ন পল্লী এলাকার মানুষের মুখে গীত-পঠিত পুথি সংগ্রহ ও গবেষণা করতেন । ড. সেন তার উপযুক্ত শিষ্য জসীম উদ্দীনকে বাংলার জেলাগুলোর বিশেষভাবে ফরিদপুর ও ময়মনসিংহ জেলার সেইসব পুঁথি (কাব্য-লোকগাথা) সংগ্রহের দায়িত্ব দেন। জসীম উদদীন পুথি সংগ্ৰহকালে গ্রামীণ জনগণের আনন্দ-বেদনার কাব্যগাথার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হন, মানুষকে ভালোবেসে একজন খাটি মানবপ্ৰেমী হয়ে ওঠেন। কবি পালাগান, গাজীর গান, জারীগান, লোকগীতির আসরে যেতেন, উপভোগ করতেন, মাঝে মাঝে নিজের বাড়িতেও লোকসঙ্গীতের আসরের আয়োজন করতেন । লোকগীতিতে সুরারোপ করেন ও বিশিষ্ট শিল্পীদের গান শেখান এবং পরবর্তীকালে কিছুকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেন । লোকসংস্কৃতির উপাদান প্রত্যক্ষ করেন। জসীম উদদীন কবিতা, নাটক, উপন্যাস, কাব্যোপন্যাস, প্ৰবন্ধ, ত্য গবেষণাগ্রন্থ, গান, ভ্রমণকাহিনী এবং ও স্মৃতিকথাসহ অর্ধশতাধিক বইয়ের রচয়িতা। কবি দুইবার এডিনবাৰ্গ উৎসবে (১৯৫০ ও ১৯৬২ সালে) এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ভয়াসহ বহু দেশে অনেক লোকসংস্কৃতি উৎসবে অংশগ্রহণ করেন। তাঁর গ্রন্থগুলো বিশ্বের বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে : ১৯৭০ সালে UNESCO তাঁর “সৌজন ব্যাদিয়ার ঘাট” ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ ও প্ৰকাশ করে । কবির ’মাটির কান্না’ কাব্যগ্রন্থটি রুশ ভাষায় একটি সংস্করণ বেরিয়েছে। ১৯৭৬ সালের ১৪ মার্চ কবি ইহলোক ত্যাগ করেন ।