"জীবন কথা" বইটি সম্পর্কে কিছু কথা: দুই বৎসর আগে অসুস্থ অবস্থায় করাচিতে বসিয়া আমি আমার জীবনকথা লিখিতে আরম্ভ করি, তারপর দেশে ফিরিয়া এই পুস্তকের প্রথম খণ্ড সমাপ্ত করিলাম। কিন্তু লিখিতে বসিয়া মনে হইল, আমার জীবনকথা বুঝি কোনােদিনই শেষ হইবার নয়। জীবনের সুদীর্ঘ পথ-বাঁকে কতজনের সঙ্গে পরিচয় হইয়া কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছি। কতজনের কাছে কত রকমের সাহায্য পাইয়াছি। তাহাদের কথাও একে একে লিখিতে হইবে। গ্রাম্য-গান সংগ্রহ করিতে আমাকে উভয় বঙ্গের বহু গ্রামে ঘুরিতে হইয়াছে। কলিকাতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ও অধ্যাপনাকালে এবং কলিকাতা ও ঢাকা সেক্রেটারিয়েটে চাকরিজীবনে আমার অনেক অভিজ্ঞতা জমা হইয়া আছে। গ্রাম্য-গান প্রচারে আমাকে বহু প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে সংগ্রাম করিতে হইয়াছে। এই উপলক্ষে কলিকাতা ও ঢাকার বহু গায়কগায়িকা ও বিভিন্ন গ্রামােফোন কোম্পানির সঙ্গে আমার পরিচয় হইয়াছে। এই সকলও লিখিতে হইবে। কিন্তু পুস্তকের কলেবর বৃদ্ধি হইয়া যায় মনে করিয়া এবারের মতাে শুধু আমার বাল্যজীবনের ঘটনাগুলিকেই প্রকাশ করিলাম। চিত্রালীতে এই পুস্তক ধারাবাহিক প্রকাশ করিয়া সােদর-প্রতিম এস, এম. পারভেজ আমার ধন্যবাদের পাত্র হইয়াছেন। চিত্রালীতে বহু পাঠক পত্র লিখিয়া গ্রন্থকারকে উৎসাহিত করিয়াছেন। একজন লিখিয়াছেন : ‘জসীম উদ্দীনের জীবনকথা পড়িতেছি না মায়ের হাতে পিঠা খাইতেছি।' ইহাদের সকলকেই আমার ধন্যবাদ জানাইতেছি।
কবি জসীম উদ্দীন ১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। পার্শ্ববর্তী গোবিন্দপুর গ্রামের পৈতৃক বাড়িতে তাঁর শৈশব কাটে। তাঁর পিতা আনসার উদ্দীন সেখানে একজন স্কুল শিক্ষক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। তিনি এলাকায় প্রেসিডেন্টও ছিলেন। কবির মাতা রাঙাছুটু ছিলেন একনজন গৃহবধূ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা সাহিত্যে মাস্টার্স ডিগ্রী অধ্যয়নকালে ও লাভের পর জসীম উদ্দীন প্রখ্যাত পণ্ডিত ড. দীনেশচন্দ্র সেনের তত্ত্বাবধানে ‘রিসার্চ ফেলো’ পদে কর্মরত ছিলেন । দীনেশ সেন সেই দিনগুলোতে বাংলাদেশের বিভিন্ন পল্লী এলাকার মানুষের মুখে গীত-পঠিত পুথি সংগ্রহ ও গবেষণা করতেন । ড. সেন তার উপযুক্ত শিষ্য জসীম উদ্দীনকে বাংলার জেলাগুলোর বিশেষভাবে ফরিদপুর ও ময়মনসিংহ জেলার সেইসব পুঁথি (কাব্য-লোকগাথা) সংগ্রহের দায়িত্ব দেন। জসীম উদদীন পুথি সংগ্ৰহকালে গ্রামীণ জনগণের আনন্দ-বেদনার কাব্যগাথার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হন, মানুষকে ভালোবেসে একজন খাটি মানবপ্ৰেমী হয়ে ওঠেন। কবি পালাগান, গাজীর গান, জারীগান, লোকগীতির আসরে যেতেন, উপভোগ করতেন, মাঝে মাঝে নিজের বাড়িতেও লোকসঙ্গীতের আসরের আয়োজন করতেন । লোকগীতিতে সুরারোপ করেন ও বিশিষ্ট শিল্পীদের গান শেখান এবং পরবর্তীকালে কিছুকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেন । লোকসংস্কৃতির উপাদান প্রত্যক্ষ করেন। জসীম উদদীন কবিতা, নাটক, উপন্যাস, কাব্যোপন্যাস, প্ৰবন্ধ, ত্য গবেষণাগ্রন্থ, গান, ভ্রমণকাহিনী এবং ও স্মৃতিকথাসহ অর্ধশতাধিক বইয়ের রচয়িতা। কবি দুইবার এডিনবাৰ্গ উৎসবে (১৯৫০ ও ১৯৬২ সালে) এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ভয়াসহ বহু দেশে অনেক লোকসংস্কৃতি উৎসবে অংশগ্রহণ করেন। তাঁর গ্রন্থগুলো বিশ্বের বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে : ১৯৭০ সালে UNESCO তাঁর “সৌজন ব্যাদিয়ার ঘাট” ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ ও প্ৰকাশ করে । কবির ’মাটির কান্না’ কাব্যগ্রন্থটি রুশ ভাষায় একটি সংস্করণ বেরিয়েছে। ১৯৭৬ সালের ১৪ মার্চ কবি ইহলোক ত্যাগ করেন ।