ফ্ল্যাপে লিখা কথা সেনরাজার শাসন থেকে স্খলিত হয়ে যাচ্ছে দেশে, তুকী আক্রমণ অত্যাসন্ন। তবু সামন্ত মহাসামন্তদের অত্যাচারের শেষ নেই। সেই অত্যাচা রুখে দাঁড়ায় কখনো অন্ত্যজরা , কখনো বৌদ্ধেরা। শাসকদের বিশেষ রোষ তাই তাদর উপরেই । তাদেরই একজন প্রশ্ন করেন : ‘দেখো, এই কি মানুষের জীবন? সুখ নাই, স্বতি নেই, গৃহ নেই, কেবলি প্রাণ নিয়ে পলায়ন করতে হচ্ছে-এর শেষ কোথায়? এ জীবন কি যাপন করা যায়? বলো, কতো দিন এভাবে চলবে?’
ইতিহাসের সেই প্রদোষকালের জটিল আবর্তে ঘূর্ণ্যমান কয়েকজন প্রাকৃত নরনারীরির কাহিণী বিবৃত হয়েছে এই উপন্যাসে। ইতিহাসে তাদের নাম নেই। হয়তো অন্য নামে তারা বাস করেছে সেই কালে, হয়তো অন্য কালেও। মৃৎশিল্পী শ্যামাঙ্গের যত্নকৃত শিল্প রজচনায় কেন ছেদ পড়ে, কিসের অন্বেষণে তাকে নিরুদ্দেশযাত্রা করতে হয়? স্বামী পরিত্যক্তা লীলাবতী কী চায়, কেন পায় না? মায়াবতীর কোমল বাহুবন্ধন ছিন্ন করে বসন্তদাস কেন মিত্রানন্দের সঙ্গী হয়?
মানুষকে স্বপরিচয়ে উঠে দাঁড়াতে বলে মিত্রানন্দ, নতজানু দাসত্ব থেকে মুক্ত হতে বলে। এর বেশি সে জানে না, জানবার আবশ্যকতাও বোধ করে না। বসন্তদাসও চায় প্রচলিত ব্যবস্থা বিধ্বস্ত করতে, কিন্তু সে আরও জানতে চায় যে, তার পরিবর্তে কী পাবে সকলে?
এসব প্রশ্নের মীমাংসা হবার আগেই ইতিহাসের ঝঞ্ঝা এসে তাদর সমূলে উৎপাটিত করে। কিন্তু এইসব জিজ্ঞাসা আর ভালোবাসা ,স্বপ্ন আর প্রয়াসের সারাৎসার তারা সঁপে দিয়ে যায় উত্তরসূরীদের হাতে।
বড়ো যত্নের সঙ্গে শওকত আলী লিখেছেন তাদের কথা, সেই সময়ের কথা। গবেষণার সঙ্গে এই বইতে যুক্ত হয়েছে দরদ, তথ্যের সঙ্গে মিলেছে অন্তর্দৃষ্টি, মনোহর ভঙ্গির সঙ্গে মিশেছে অনুপম ভাষা। ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ আমাদের উপন্যাসের ধারায় একটি স্মরণীয় সংযোজন। আনিসুজ্জামান
শওকত আলীর (জন্ম: ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৬ - ২৫ জানুয়ারি, ২০১৮)। জন্মস্থান পশ্চিম বাংলার পশ্চিম দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জ। স্কুলের পড়াশোনা শ্ৰীরামপুর ও রায়গঞ্জে। দেশ-বিভাগের চার বছর পর তাঁর চিকিৎসক পিতা সপরিবারে দিনাজপুর শহরে চলে এলে শওকত আলী সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে কলেজ শিক্ষকতায় নিয়োজিত হন। ঢাকার জগন্নাথ কলেজে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে দীর্ঘ পাঁচিশ বছর অধ্যাপনা করার পর বর্তমানে তিনি সরকারী সংগীত মহাবিদ্যালয়ে অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত। একটি ছোট উপন্যাস ‘পিঙ্গল আকাশ” (১৯৬৪) তাঁর প্রথম প্রকাশিত বই। এর পর প্রকাশিত হয়েছে। দুটি ছােটগল্প সংকলন ও একটি উপন্যাস। শিশুকিশোরদের জন্যেও তিনি লিখে থাকেন। বাংলা ছোটগল্পে বিশেষ অবদান রাখার জন্য শওকত আলী বাঙলা একাডেমি পুরস্কার পান ১৯৬৮ সালে। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ লেখক শিবির তাঁকে হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার প্রদান করে। এ ছাড়াও তাঁকে ১৯৮৩ সালে অজিত গুহ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৬ সালে ফিলিপূস সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৯ সালে আলাওল সাহিত্য পুরস্কার এবং ১৯৯০ সালে রাষ্টিয় পুরস্কার ২১শের পদকে ভূষিত করা হয়। নৃতত্ত্ব, সমাজবিজ্ঞান ও ইতিহাসে তাঁর আগ্ৰহ অত্যন্ত গভীর। বাংলার প্রায়—লুপ্ত ও ঝাপসা ইতিহাসে তাঁর সৃজনশী অনুসন্ধান আমাদের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করতে সাহায্য করেছে।