তখন সময় ছিল একেবারে অন্য রকম। এত শহর ছিল না। শহরে এত মানুষ ছিল না। গাড়িঘোড়া এত ছিল না। আমরা বলি গাড়িঘোড়া। কিন্তু ঢাকা শহরে গাড়ি আছে, ঘোড়া কই? ছিল, একসময়ে ঘোড়া ছিল, এখন নেই। তখন বাস ছিল না, ট্যাক্সি ছিল না, মোটরগাড়ি ছিল না, কিন্তু এখন সবই আছে। কেবল ঘোড়গাড়ি বা ঘোড়ার গাড়ি নেই। গাড়িঘোড়া আর ঘোড়গাড়ি এক জিনিস নয়। এখন শুধুই গাড়ি। কত রকম—রকম গাড়ি। কত রংবেরঙের গাড়ি। অথচ শহরে ঘোড়া দেখা যায় না। ঘোড়গাড়ি টেনে নিয়ে যাচ্ছে ঘোড়া, সেই ঘোড়গাড়িতে মানুষ বসে আছে এ রকম দেখা যায় না। অন্তত ঢাকা শহরে এমন ঘটনা এখন কেউ দেখতে পায় না। বাংলাদেশে আর কোথাও কি এরকম ঘোড়গাড়ি আছে? দু—এক স্থানে থাকলেও থাকেত পারে। সময় তো সর্বদা এক রকম থাকে না। আগে এক রকম ছিল, এখন আরেক রকম। সময় পাল্টেছে। সারা দেশ জুড়ে ছিল গ্রাম। কেবলই গ্রাম। বড় গ্রাম, ছোট গ্রাম, মাঝারি আকারের গ্রাম। কোথাও কয়েকটি গ্রাম পাশাপাশি। কোথাও আবার দূরে দূরে। যদি পাশাপাশি হয়, তখন এক গাঁ থেকে আরেক গাঁ যেতে কোনো অসুবিধে নেই। কিন্তু দূরে হলে? তখন হয়তো হেঁটে হেঁটে একটা বড় মাঠ পার হতে হবে। সাইকেল থাকলে অবশ্য সুবিধে হয়, কম সময়ে পেঁৗছানো যায়। কিন্তু গ্রামগুলোর মাঝখানে যদি খালবিল থাকে, জলা থাকে, নদী থাকে? তখন না পায়ে হাঁটা, না সাইকেলে চাপা, কোনোটাই চলবে না। তখন কাজে লাগবে ডিঙি নৌকা। পানির ওপরে নৌকা ছাড়া আর কিছু তো চলে না। দেশময় গাঁওগেরাম ছড়িয়ে থাকত এইভাবে। শহর ছিল মাত্র দু—চারটে। তাও আবার অনেক দূরে দূরে। গাঁয়ের লোক শহরে যেতে ভয় পেত। প্রথম কারণ : শহর তো কাছে নয়, তাই যেতে পরিশ্রম হয়, সময় লাগে। দ্বিতীয় কারণ : শহুরে মানুষের কাপড়—জামা, পোশাকআশাক সব অন্য ধরনের, কথাবার্তাও কেমন যেন, তাই ভয় করে। তৃতীয় কারণ : শহরের লোকজন সবসময় বড়ো ব্যস্ত, গল্পগুজব করার সময়ই পায় না, তা হলে বেড়াতে গিয়ে কী লাভ? এই তিন কারণ ছাড়াও চার নম্বর একটা কারণ ছিল। সেই কারণটিই ছিল সবচাইতে বেদনার, দুঃখ—কষ্টের। সেটি হলো শহুরে মানুষজন গাঁওগেরামের মানুষদের যেন মানুষ বলেই মনে করে না, অবহেলা করে, আদর—যত্ন করে না, ভালোভাবে কথা বলে না। শহরের লোকের মনে অনেক দেমাগ, ভারি অহংকার। গাঁয়ের লোক এই রকম ভাবে। আর ভাবে বলেই দরকার ছাড়া শহরে—বন্দরে যাওয়া—আসা করে না, সেখানকার বাসিন্দাদের তেমন পছন্দ করে না। শহর আর গ্রাম, বন্দর আর গেরাম—গন্জো আলাদা—আলাদা নিজের মতো পড়ে থাকে। দূরে—দূরে থাকে, কাছে আসে না। অথচ গ্রাম যে—দেশের শহরও সে—দেশেরই। দেশ তো একটাই আর তার নাম বাংলাদেশ। এরই আরেকটা নামু পুব—বাংলা বা পূর্ববঙ্গ। এই দেশেরই এক বিখ্যাত ব্যক্তি নিয়ে আমরা একটু গল্প—গুজব করব। বিখ্যাত কেন? বিখ্যাত হওয়ার কারণ, এই মানুষটি যে কবি। সবাই কি কবিতা লিখতে পারে? পারে না। যিনি লিখতে পারেন তাঁকে সবাই ‘কবি’ বলে
হায়াৎ মামুদের জন্ম ব্রিটিশ ভারতে, পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার মৌড়া নামে আখ্যাত এক গ্রামে, ১৩৪৬ বঙ্গাব্দের ১৭ আষাঢ় (২রা জুলাই ১৯৩৯) তারিখে । ১৯৫০ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার অভিঘাতে মানসিকভাবে বিপর্যন্ত পিতার হাত ধরে চলে আসতে হয় ঢাকা শহরে । অদ্যাবধি সেখানেই বসবাস । স্কুল-কলেজ -বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সমাপ্ত করেছেন এ শহরেই। পিএইচ. ডি. ডিগ্রি তুলনামূলক সাহিত্যে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, প্ৰায় প্রৌঢ় বয়সে। রুশ ভাষা অল্পবিস্তর জানেন, অনুবাদের চাকরি করেছেন প্ৰগতি প্ৰকাশনে, মস্কোয়-সুদূর ও স্বপ্রিল সোভিয়েত ইউনিয়নে বসে । দেশের অভ্যন্তরে চাকরি সর্বদাই শিক্ষকতার-প্ৰথমে কলেজে পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে । বর্তমানে অবসর-জীবন যাপন করছেন। বাংলা একাডেমী পুরস্কার পেয়েছেন শিশুসাহিত্যে । দেশ-বিদেশের সারস্বত সমাজের সঙ্গে যোগাযোগ আছে । সমালোচনা, ছাত্রপাঠ্য বই ইত্যাদি মিলিয়ে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ষাটেরও বেশি।