আমি কোনোদিন নীরার সাথে তর্কে পারিনি। তাই প্রমাদ গুনলাম আর চুপ করে রইলাম। নীরা চালিয়ে যেতে লাগল—'দিন দিন তুই উচ্ছন্নে যাচ্ছিস। পড়াশুনা ছেড়ে যা তা করে বেড়াচ্ছিস। হরিকাকার সাথে মেলামেশা তোকে ছাড়তে হবে। বড়দিদি নিশ্চুপে আমার পিঠে মলম লাগিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে মা এল। সাথে ঠাকুমা। ঠাকুমা বললেন—'তোর এত বাড় কবে থেকে হলো বল তো? এইটুকু ছেলের এত বাড় ভালো না এই বলে দিলাম। বউমা একটু শাসন দরকার ওর।" — দেখলেনই তো মা ওর বাবা কেমন ওকে চোরের মারটা মারল। আর একটু হলে মরেই যেত!' – কি যে বল বউমা! আমাদের পরিবারের লোকেরা হলো কৈমাছের প্রাণ। অত সহজে তা যাবে না।' দেখুন না পিঠের কী হাল হয়েছে।' বলে মা ঠাকুমার দৃষ্টি আকর্ষণ করালেন। এতক্ষণে ঠাকুমা দেখলেন—'হেই মা রে! করেছে কী ছেলেটাকে! এত রাগ ভালো কথা না। রেগে গেলে বড়ো খোকা আর মানুষ থাকে না, সাক্ষাৎ পিচাশ হয়ে ওঠে। বরবার লক্ষ্য করে এসেছি। আহা রে আমার বাছাটাকে একবারে ফুলিয়ে দিয়েছে। মায়েরা চলে যাবার কিছুক্ষণ পর আমি ঘুমিয়েছি। কতক্ষণ জানি না। তারপর বড়দিদি ইরা এসে আমাকে রাতের খাবার জোর করে খাইয়ে দিয়েছে। তারপর আমি আবারও ঘুমিয়ে পড়েছি। পিঠে আর সারা গায়ে অসম্ভব ব্যথা। ব্যথার দাপটে জমাট ঘুম আসেনি ঘুম আর জাগরণের মাঝের এক অবস্থায় আমি রয়েছি। মাঝে মাঝে চোখ লাগে আবার ব্যথার তাড়সে ঘুম চলে যায়। এভাবে কতক্ষণ পেতেছে জানি না, তবে বেশ রাতই হবে। হঠাৎ করে একটা অস্বস্তিতে ঘুম ভেঙে গেল। যেন কেউ দেখছে আমাকে। তাকিয়ে দেখি বাবা। বাবা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। জানালা দিয়ে শুক্লপক্ষের চাঁদের আলো এসে পড়েছে আমার সারা ঘরে। সেই আলোয় দেখি তার চোখ চিকচিক করছে অব্যক্ত এক ব্যথা যেন তার সারা মুখে, সারা মনে। আমার মনে হলো আমার ব্যথা শরীরে, আর বাবার ব্যথা অনেক গভীরে। আমি নড়াচড়া করতেই বাবা চলে গেল । বাবার সেই চাহনি আমার মনে কেমন যেন একটা ব্যথা বিহালতার সৃষ্টি করল। একটা কান্না গলার কাছে দলা পাকিয়ে উঠতে লাগল। আমি কিছু বলতে পারিনি। বাবাও কিছু বলেনি। কিন্তু বাবার সেই চাহনিই আমাকে সেদিন অনেক কিছু বলে দিয়েছিল।