সুনীতি এক উন্নয়নকর্মী। চাকরিসূত্রে তার বসবাস গ্রামে। সে একজনকে ভালোবাসে। একবার শহর থেকে গ্রামে ফেরার পথে রাত হয়ে যায়। পথিমধ্যে সুনীতিকে ধর্ষণ করে তারই এক সহকর্মী। যে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় সুনীতি ফিরছিল, তার চালক ধর্ষক সহকর্মীকে আটকে রেখে সুনীতিকে ধর্ষণ করে। সুনীতি উপর্যুপরি দ্বিতীয়বার ধর্ষণের শিকার হয়। নৌকাচালক সুনীতি ও তার সহকর্মীকে আটকে রেখে ঘটনা অন্যদিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা চালায়। গ্রামে আয়োজন করে এক সালিশের। সালিশে উভয়ের বিয়ে পড়িয়ে দেয়া হয়। আর সুনীতিকে মারা হয় দোররা। সুনীতি এই বিয়ে অস্বীকার করে। একপর্যায়ে সহকর্মী চন্দ্রভানুকে নিয়ে প্রতিশোধের কৌশল আঁটে। প্রথমেই ধর্ষক সহকর্মীর একটি চোখ নষ্ট করে দেয়া হয়। পুড়িয়ে দেয়া হয় ফতোয়াবাজ মোড়লের ঘরবাড়ি। একপর্যায়ে হত্যা করা হয় ধর্ষক নৌকাচালককেও। সুনীতি জ্বলতে থাকে প্রতিশোধের আগুনে। চন্দ্ৰভানু তার সহায়ক শক্তি। ধর্ষণের ফলে সুনীতির গর্ভে যে সন্তান জন্ম লাভ করে, তাকে নিয়ে সে যাত্রা করে টুঙ্গিপাড়ার উদ্দেশে। তার সঙ্গে সহযাত্রী হয় ফতোয়াবাজের শিকার একদল মানুষ। তারা এমন একটি জায়গায় যেতে চায় যেটি একজন অসাধারণ মানুষের জন্মস্থান, যেখানে গেলে তারা লাভ করবে জেগে ওঠার শক্তি। এই উপন্যাস এ দেশের নারীসমাজের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের আখ্যান। কাহিনীর শেষে মনে হবে মানুষই পারে নতুন জন্মের ঘোষণা দিতে। মানুষই দলভুক্ত হয় এক্সোডাসের এবং মানুষের পক্ষেই সম্ভব পুনরুত্থান।
২১টি উপন্যাস, ৭টি গল্পগ্রন্থ ও ৪টি প্রবন্ধগ্রন্থের রচয়িতা সেলিনা হোসেন বাংলাদেশের একজন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক। সমকালীন রাজনৈতিক সংকট ও দ্বন্দ্বের উৎস ও প্রেক্ষাপট উঠে এসেছে সেলিনা হোসেন এর বই সমূহ-তে। সেলিনা হোসেন এর বই সমগ্র অনূদিত হয়েছে ইংরেজি, রুশসহ একাধিক ভাষায়। প্রবীণ এ লেখিকা ২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশ শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর কর্মজীবন থেকে অবসর নেন। সেলিনা হোসেন ১৯৪৭ সালের ১৪ই জুন রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন। আদি পৈতৃক নিবাস নোয়াখালীতে হলেও সেখানে বেশি দিন থাকা হয়নি তার। চাকরিসূত্রে তার বাবা রাজশাহী চলে এলে সেটিই হয়ে ওঠে সেলিনার শহর। স্থানীয় এক বালিকা বিদ্যালয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে রাজশাহী মহিলা কলেজে ভর্তি হন। ছোটবেলা থেকেই সাহিত্য পড়তে ভালোবাসতেন তিনি। আর ভালোবাসার টানে উচ্চ মাধ্যমিক শেষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। এখান থেকেই স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমির গবেষণা সহকারী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন সেলিনা হোসেন। এরপর সরকারি কলেজে শিক্ষকতা এবং পাবলিক সার্ভিস কমিশনেও কাজ করেছেন তিনি। পাশাপাশি পত্রপত্রিকার জন্য চালিয়ে গেছেন তার কলম। টানা ২০ বছর তিনি ‘ধান শালিকের দেশ’ পত্রিকার সম্পাদনা করেন। ১৯৯৭ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমির প্রথম নারী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সেলিনা হোসেন মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস রচনা করে পাঠকমনে চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। তার রচিত মুক্তযুদ্ধ বিষয়ক কালজয়ী উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ নিয়ে তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্রও। ‘যাপিত জীবন’, ‘ক্ষরণ’, ‘কাঁটাতারে প্রজাপতি’, ‘ভালোবাসা প্রীতিলতা’, ‘যুদ্ধ’, ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ (তিন খণ্ড) ইত্যাদি তার জনপ্রিয় উপন্যাস। ‘স্বদেশে পরবাসী’, ‘একাত্তরের ঢাকা’, ‘ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন’ ইত্যাদি তার জনপ্রিয় প্রবন্ধ। কিশোরদের জন্য তিনি লিখেছেন ‘কাকতাড়ুয়া’, ‘চাঁদের বুড়ি পান্তা ইলিশ’, ‘আকাশ পরী’, ‘এক রূপোলি নদী’ সহ বেশ কিছু সুপাঠ্য গ্রন্থ। সাহিত্যাঙ্গনে এই অনবদ্য অবদানের জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডি.লিট ডিগ্রি প্রদান করে। এছাড়াও তিনি ‘আলাওল সাহিত্য পুরস্কার’, ‘রবীন্দ্রস্মৃতি পুরস্কার’, ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’ সহ অসংখ্য পদক পুরস্কার পেয়েছেন।