ভূমিকা সমস্তই শুরু হয় বিদ্যাসাগর নিয়ে একটি নিবন্ধ লিখতে গিয়ে। দেখলাম যে পাশ্চাত্য প্রভাব সত্ত্বেও বিদ্যাসাগরের মনের ছাঁচ তৈরি নব্য ন্যায়ের লজিক্যাল গঠনে। ব্যক্তিগতভাবে একটি নৈয়ায়িক পরিবারের ঐতিহ্য বহন করি বলে দেখেছি প্রচলিত ধর্মের আচার অনুষ্ঠান আমাদের পরিবারে অনেকখানিই ব্রাত্য ছিল। একটা আধ্ম্যাত্মিক আবহ কাজ করত। অর্থাৎ রিলিজিয়াস নয়, স্পিরিচুয়াল। এই নৈয়ায়িকদের একটা বৈশিষ্ট্যই পৌত্তলিকতা সম্পর্কে খানিকটা ঔদাসীন্য। এটা নাস্তিকতা নয়, কিন্তু তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া। বিদ্যাসাগরের আগেও আমরা এমন নৈয়ায়িক পণ্ডিতদের পেয়েছি। উদাহরণ হিসেবে জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের কথা বলা যেতে পারে। ত্রিবেণী নিবাসী এই অসাধারণ পণ্ডিত তিন বছর পরিশ্রমে আটশ পাতার হিন্দু আইন সংকলন করেন। অসামান্য শ্রুতিধর এই পণ্ডিত ১০৪ বছর বেঁচেছিলেন। মৃত্যু আসন্ন দেখে তাঁকে গঙ্গাতীরে আনা হলে তাঁর প্রধান এক নৈয়ায়িক ছাত্র বলেন ‘গুরুদেব! নানা শাস্ত্র পড়াইয়া বুঝাইয়া দিয়াছেন, কিন্তু ঈশ্বর কী বস্তু তাহা এক কথায় বুঝাইয়া দেন নাই।’ সেই সময়ও তাঁর তীক্ষ্ণবুদ্ধি ও রসবোধ অক্ষুণ্ণ ছিল। অন্তর্জলি অবস্থায় তর্কপঞ্চানন একটু হেসে তাৎক্ষণিক একটি শ্লোক রচনা করে ছাত্রকে বলেন নরাকারং বদন্ত্যেকে নিরাকারাঞ্চ কেচন। বয়ন্তু দীর্ঘসম্বন্ধাত নারাকারাম (নীরাকারাম) উপাস্মহে।। যার অর্থ, এক দল ঈশ্বরকে নরাকার বলেন, কেউ বা নিরাকারও বলেন। কিন্তু আমরা দীর্ঘ সম্বন্ধের জন্য (অর্থাৎ বহুকাল গঙ্গাতীরে বাস করার জন্যে) নারাকারাকে অর্থাৎ নীরাকারাকে মানে জলকে উপাসনা করি, মানে এই নদীটিকে ঈশ্বর ভাবি। একজন শতবর্ষ অতিক্রান্ত মৃত্যুপথযাত্রীর মেধার দীপ্তি আমাদের অবাক করে দ্যায়। বেগুন কোন তিথিতে খেতে হবে এমন চালকলাবাঁধা বামুনের পাশাপাশি কিন্তু এমন উজ্জ্বল পণ্ডিতরাও ছিলেন, বিদ্যাসাগর যাঁদের উত্তরাধিকার বহন করছেন। আমার তখন মনে পড়ল আমার ঠাকুমাকে। খুব ছোটবেলায় বিয়ে হওয়ায় সামান্য অক্ষর পরিচয়ও তাঁর ছিল না, কিন্তু কী আশ্চর্য ছিল তাঁর মেধা। বাবার মুখে শুনেছি আমার পিতৃকুলে অষ্টাদশ শতকে লক্ষ্মী সরস্বতী নামে দুই মেয়ে ছিলেন, যাঁরা কাশী থেকে আসা এক বিখ্যাত পণ্ডিতকে তর্কযুদ্ধে হারিয়ে দিয়েছিলেন বলে তাঁদের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়, তাঁরা পরে নাকি কাশীতে টোল খুলে বসেন। অর্থাৎ প্রশ্ন করার অভ্যেস, অন্যায়ের প্রতিবাদ করা, কোনও কিছু নির্বিচারে মেনে না নেওয়া— এসব আমাদের সমাজেই ছিল। হয়তো অন্ধকার বেশি ছিল, কিন্তু আলো ছিলই। রামমোহন, বিদ্যাসাগর— এঁরা কেউ আকাশ থেকে পড়েননি, তাঁদের জন্য অনেক আগে থেকেই মাটি তৈরির কাজ চলছিল। আর কেউ যদি প্রশ্ন করেন, জয়াবতী বলে সত্যি কি কেউ ছিল? অমন তার্কিক, বুদ্ধিমতী, প্রতিবাদী মেয়ে কি থাকতে পারে অষ্টাদশ শতকের কুসংস্কার আর কূপমণ্ডূকতায় আচ্ছন্ন বাংলায়, তবে আমি বলব, থাকা অসম্ভব কিছু ছিল না। অসম্ভব ছিল না তার অভিযানও। তাই তরুণ লেখক কৃষ্ণেন্দু দেব যখন একটি অভিযানের গল্প সংকলনের জন্য গল্প চাইলেন, তখন ইচ্ছে হয়ে মনের মাঝারে থাকা জয়াবতীই মূর্ত হয়ে উঠল। সেই গল্পের বীজ থেকেই বোনা হল পরবর্তী উপন্যাসটি। আমাজনের জঙ্গলে বা আটলান্টিকে নয়, কুসংস্কার ভরা সমাজের বদ্ধ জলার ওপর দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে একটি মুক্তমনা মেয়ের বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে চলার দুঃসাহসিক এবং একইসঙ্গে মজার কাহিনি সব বয়সের পাঠককেই জয়ের স্বাদ এনে দেবে, এ কথা হলফ করে বলা যায়। ধন্যবাদ কৃষ্ণেন্দুকে। ধন্যবাদ মৌসুমি ঘোষকেও, যে খুব যত্ন করে ধারাবাহিকভাবে এই উপন্যাসটি প্রকাশ করেছে জ্বলদর্চি বৈদ্যুতিন পত্রিকায়। ধন্যবাদ রোহণ কুদ্দুস ও তার সৃষ্টিসুখ প্রকাশনকে, যাদের আগ্রহে ‘জয়াবতীর জয়যাত্রা’ গ্রন্থাকারে প্রকাশ পাচ্ছে। তৃষ্ণা বসাক