আর রাহীকুল মাখতুম কুরআন মাজীদে আল্লাহ তা‘আলার ব্যবহৃত একটি বাক্যাংশ, যার অর্থ ছিপি আঁটা উত্তম পানীয়, সূরা আল মুতাফ্ফিফীন-এ আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নেক বান্দাহদের পুরস্কার হিসেবে জান্নাতে এ পানীয় সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। প্রিয়জনদের জন্য এ পানীয় ‘শুধু ছিপি আঁটা’ বোতলেই তিনি ভরে রাখেননি-পাত্রজাত করার সময় এতে কুস্তুরীর সুগন্ধিও তিনি মেখে রেখেছেন। কুরআন মাজীদে বর্ণিত আর ‘রাহীকুল মাখতুম’ মুমেনদের জন্যে সত্যিই এক শ্রেষ্ঠ পাওনা, যাদের জন্যে এ মহা আয়োজন তাদের সর্দারের জীবনীগ্রন্থ আর রাহীকুল মাখতুম সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী একটি ভিন্ন স্বাদের সীরাত গ্রন্থ।এমন একটি গ্রন্থ রচনা করে সীরাতের মহান পণ্ডিত আল্লামা সফিউর রহমান মুবারকপুরী একটি অসামান্য কাজ সম্পাদন করেছেন সন্দেহ নেই, মূলত এর মাধ্যমে তিনি জমিনের রাহীক-এর সঙ্গে আসমানের রাহীক-এর এক ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র স্থাপন করে দিয়ে গেলেন। প্রতিযোগিতায় ১১৮২টি পুস্তকের মধ্যে এ বইটিকে কেন বিরল সম্মানে ভূষিত করা হয়েছে, কোন্ সে বৈশিষ্ট্য, যে কারণে বইটি যুগের সেরা সীরাত গ্রন্থের মর্যাদা পেয়েছে। সারা দুনিয়ার রাসূল প্রেমিকরা মনে হয় এমন একটি সীরাত গ্রন্থের জন্যে বহুদিন ধরে অপেক্ষা করছিল যাকে এ বিষয়ের ওপর রচিত অতীতের সব ক’টির নির্ভরযোগ্য উপাদানের সমন্বয়ে তৈরি করা হবে, অপর কথায় যা হবে সীরাত সংক্রান্ত বিশাল পাঠাগারের একটি নির্যাস। সেদিক থেকে বিচার করলে আল্লামা সফিউর রহমান মুবারকপুরীর এ মোবারক উদ্যোগটি নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমানদের পক্ষ থেকে রাবেতায়ে আলামে ইসলামীর বইটিকে প্রথম পুরস্কার প্রদান করার মাধ্যমে এ প্রশংসারই স্বীকৃতি মিলেছে। আর রাহীকুল মাখতুম বইটিতে অসংখ্য প্রন্থের নাম ও তার পৃষ্ঠা নম্বর দেয়া আছে, সে ব্যাপারেও মনে হয় একটা কথা বলে নেয়া প্রয়োজন। যেসব পৃষ্ঠার নম্বর এখানে দেয়া হয়েছে তা হচ্ছে আরবি ও উর্দু গ্রন্থের পৃষ্ঠা। এর ভেতরে এমন অনেক বইয়ের তিনি রেফারেন্স দিয়েছেন যা এখনো বাংলায় অনুবাদ হয়নি, যেগুলোর অনুবাদ হয়েছে সেখানেও এ পৃষ্ঠার নম্বর দিয়ে মূল তথ্যের কোনো সন্ধান পাওয়া যাবে না। যেমন মূল লেখক তার বই-এর বহুজায়গায় সাইয়্যেদ কুতুব শহীদের বিখ্যাত ফী যিলালিল কুরআন-এর উদ্ধৃতিদিয়েছেন, কিন্তু সেখানে তিনি যে খণ্ড ও পৃষ্ঠা নম্বর দিয়েছেন তা শুধু আরবি সংস্করণের বেলায় প্রযোজ্য। বাংলা ভাষায় তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন-এর যে অনুবাদ বেরিয়েছে স্বাভাবিকভাবেই তার খণ্ড ও পৃষ্ঠার কোনোটাই এর সাথে মিলবে না। এ সমস্যা জেনেও একান্ত আমানতদারীর খাতিরে আমরা মূল লেখকের দেয়া কোনো তথ্য সূত্র পরিবর্তন করিনি। তাই এই বইটির অনুবাদের মানও খুবই উচ্চমানের, এবং বাংলাভাষায় অনূদিত রাহীকুল মাখতুমের অন্যতম সেরা অনুবাদ এটি।
আল্লামা সফিউর রহমান মুবারকপুরি (১৯৪৩-২০০৬) পুরো নাম সফিউর রহমান ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাম্মাদ আকবর ইবনে মুহাম্মাদ আলি ইবনে আব্দুল মুমিন মুবারকপুরি আযমি। তিনি একজন স্বনামধন্য ইসলামিক লেখক এবং ভারত উপমহাদেশের বিখ্যাত মুহাদ্দিস। তার লেখা রাসূল সা.-এর জীবনীগ্রন্থ আর-রাহিকুল মাখতুম সারা বিশ্বে অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং বহু ভাষায় অনুদিত একটি বই আধুনিক সিরাতগ্রন্থ। তিনি ১৯৪২ সালের ৪ জুন ভারতের আযমগড় জেলার হোসাইনাবাদের মোবারকপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলায় তিনি স্থানীয় শিক্ষকদের কাছে লেখাপড়া করেন এবং আরবী ভাষা, ব্যকরণ, সাহিত্য, ফিকাহ, উসূলে ফিকাহ, তাফসির, হাদিস ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞান লাভ করেন। ১৯৬১ সালে তিনি শরীয়াহ বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রী লাভ করেন একই সাথে মাদরাসায় শিক্ষকতা এবং লেখালেখি শুরু করেন। ১৯৬৯ সালে মুবারকপুরের দারুত তালিম মাদরাসায় এবং ১৯৭৪ সালে বেনারসের জামিয়া সালাফিয়ায় শিক্ষকতা করেন। ১৯৮৮ সাল হতে তিনি মদিনাস্থ আন্তজার্তিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাসূল সা. বিষয়ক গবেষণা ইন্সটিটিউটে কর্মরত থাকেন। সর্বশেষ রিয়াদের মাকতাবায়ে দারুস সালামে গবেষণার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। এছাড়া বেনারসের মাসিক মুহাদ্দিস পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্বও পালন করেছেন। আরবী ও উর্দু ভাষায় তাঁর রচিত গ্রন্থসংখ্যা ত্রিশোর্ধ্ব। ২০০৬ সালের ১ ডিসেম্বর জুমাবার বেলা দু’টায় এই নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে এই মহান মনীষী মাওলার সান্নিধ্যে চলে যান।