১৯৪৬ খৃস্টাব্দে আমি বৌলতলি উচ্চ ইংরাজি বিদ্যালয়ে ভর্তি হই। ফরিদপুরের মহকুমা শহর গোপালগঞ্জের কাছে বৌলতলি গ্রাম। এই গ্রামেই বৌলতলি উচ্চ ইংরাজি বিদ্যালয় । বিদ্যালয়ের বাড়িটি একতলা - ইটের পাকা বাড়ি। বাড়িটি পশ্চিম থেকে পূৰ্বে লম্বিত । বাড়িটি মাঠের উত্তর পাশে অবস্থিত। এই মাঠেই আমরা খেলতাম ফুটবল, হকি, ভলিবল ইত্যাদি। মাঠের পুবপাশে পাকা বাড়ির সঙ্গে লম্বভাবে অবস্থিত একটি অতি দীর্ঘ দোচালা । এই টিনের দোচালাতেও পাঠদান করা হতো। পাকা বাড়িটির পশ্চিমে ছিলো ছাত্রাবাস। ছাত্রাবাসটিও পশ্চিম থেকে পুবে লম্বিত। এই ছাত্রাবাসে থাকতাম আমি এবং আমার দুই সহোদর অনিল মজুমদার ও সুনীল মজুমদার। ছাত্রাবাসে সব মিলিয়ে জনা কুড়ি আবাসিক ছিলাম। আমিই বয়োকনিষ্ঠ। ১৯৪৭ সালে বিদ্যালয়ে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলো যে বিদ্যালয়ের ছাত্রদের সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হবে, অবিলম্বে ছাত্রগণ লেখা জমা দাও ।
বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেলো ছাত্রাবাসের সবাই কাগজ-কলম নিয়ে গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ লেখায় মনোনিবেশ করেছে। বলা বাহুল্য, এইসব ছাত্রের কারোই লেখা অভ্যাস ছিলো না। বিদ্যালয়ের পত্রিকা প্রকাশিত হবে, শীঘ্র লেখা দাও এই বিজ্ঞপ্তি পড়ার পর প্রতি বছরই ছাত্রগণ দিন পনেরো লিখতো। আমিও কাগজ-কলম নিয়ে ব'সে গেলাম। কবিতা লেখার চেষ্টা করলাম। এবং একটি কবিতা লিখলাম। সে ১৯৪৭ খৃস্টাব্দ। আমার জন্ম হয় ১৯৩৪ খৃস্টাব্দের ১৭ই সেপ্টেম্বর। এই কবিতাটিই আমার রচিত প্রথম কবিতা এবং কবিতাটি ১৯৪৭ খৃস্টাব্দের বৌলতলি বিদ্যালয়ের ছাত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এরপর থেকে আমি কোনোদিন আর লেখা থামাইনি। অর্থাৎ বছর তিরিশ যাবৎ লিখছি। প্রধানত কবিতাই লিখছি। ১৯৪৮ খৃস্টাব্দের বৌলতলি বিদ্যালয়ের ছাত্রপত্রিকায় আমার আরেকটি কবিতা প্রকাশিত হয়। এর পরেই ১৯৪৮ খৃস্টাব্দের ডিসেম্বর মাস নাগাদ আমি কলকাতায় চ'লে আসি।
কলকাতায় এসে মহা সুবিধা হয়ে গেলো। কলকাতায় পাড়ায় পাড়ায় গ্রন্থাগার। আমি পড়তে খুব ভালোবাসতাম। তালতলায় থাকতাম। তালতলা সাধারণ পাঠাগারের সভ্য হলাম অচিরেই। এবং দৈনিক একখানা ক'রে নতুন বই পড়তাম।
বিনয় মজুমদার বা মংটু (জন্ম : ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৪- মৃত্যু : ১১ ডিসেম্বর, ২০০৬) একজন বিশিষ্ট ভারতীয় বাঙালি কবি ও ইঞ্জিনিয়ার। কবি বিনয় মজুমদার মায়ানমারের মিকটিলা জেলার টোডো নামক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম বিপিনবিহারী মজুমদার, মায়ের নাম বিনোদিনী। তারা ছিলেন ছয় ভাই-বোন এবং তিনি ছিলেন সবার ছোট। তার ডাক নাম মংটু। "ফিরে এসো চাকা" ছিল তার অতি জনপ্রিয় কাব্যগ্রন্থ। ১৯৪২ সালে তাকে বাংলাদেশের একটি স্কুলে ভর্তি করা হয়। ১৯৪৪ সালে তিনি প্রথম বিভাগে ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষায় পাশ করেন। ১৯৪৬ সালে তাকে বৌলতলী উচ্চবিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করা হয়। ১৯৪৮ সালে দেশভাগের সময় তারা সপরিবারে ভারতের কলকাতায় চলে আসেন। এখানে, ১৯৪৯ সালের জানুয়ারি মাসে তাকে কক্রিক রো-রতে অবস্থিত মেট্রপলিটন ইনস্টিটিউট (বউবাজার ব্রাঞ্চ)-এ নবম শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়। প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হবার পরে, ১৯৫১ সালে আইএসসি (গণিত) পড়ার জন্য প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫৭ সালে তিনি ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে পাশ করেন। শোনা যায়, তার পাওয়া নম্বর আজও কেউ নাকি ভাঙতে পারেন নি। ১৯৫৮ সালের জানুয়ারি মাসে, অর্থাৎ ছাত্রজীবন সমাপ্ত হবার কয়েকমাস পরেই এনবিএ থেকে প্রকাশিত হয় "অতীতের পৃথিবী" নামক একটি অনুবাদ গ্রন্থ। এই বছরেই গ্রন্থজগৎ থেকে বের হয় তার প্রথম কাব্য গ্রন্থ 'নক্ষত্রের আলোয়'। তার মৃত্যুর কয়েক বছর আগে তাকে দুটি বড় পুরস্কার দেওয়া হয়, রবীন্দ্র পুরস্কার এবং একাডেমি পুরস্কার। তিনি দীর্ঘ রোগভোগের পরে ২০০৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন।