আমাদের দেশে দুই শত বছরের বেশি সময় ধরে আঞ্চলিক ইতিহাস রচনার কাজ চলছে। জাতীয় ইতিহাসচর্চার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো আঞ্চলিক ইতিহাস রচনা। বিভিন্ন অঞ্চলের ইতিহাস দিয়েই সমৃদ্ধ হতে পারে জাতীয় ইতিহাস। জাতীয় ইতিহাসে একটি অঞ্চলের ভৌগোলিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস পুরোপুরি তুলে ধরা সম্ভব হয় না; কিন্তু আঞ্চলিক ইতিহাসে নিখুঁতভাবে তা লিপিবদ্ধ হয়। তাই আঞ্চলিক ইতিহাস একটি জাতি বা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য প্রামাণ্য দলিলরূপে গণ্য হয়। বাংলাদেশে আঞ্চলিক ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে চলনবিল অঞ্চল অনেকটাই অগ্রগামী। পাবনা জেলাকে নিয়ে রাধারমণ সাহা প্রথম ইতিহাস গ্রন্থ ‘পাবনা জেলার ইতিহাস’ প্রকাশ করেন প্রায় একশত বছর আগে (১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে)। গ্রন্থটি ছয় খ-ে পর্যায়ক্রমে প্রকাশিত হয়। বর্তমানে এর (অখ-) পৃষ্ঠাসংখ্যা ৫৩৮। এরপূর্বে অবশ্য মৌলবী মোখতার আহমদ সিদ্দিকী ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে ‘সিরাজগঞ্জের ইতিহাস’ নামে ৪৮ পৃষ্ঠার একটি বই বের করেন। তখন সিরাজগঞ্জ ছিল পাবনা জেলার একটি মহকুমা। ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে এম. এ. হামিদ প্রকাশ করেন ‘চলনবিলের ইতিকথা’ নামে একটি গ্রন্থ (পৃষ্ঠাসংখ্যা ৫০২)। ‘চলনবিলের ইতিকথা’ গ্রন্থটিতে মূলত পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও নাটোর জেলার ওপর দিয়ে বিস্তৃত ও বিধৌত চলনবিল অঞ্চলÑ পাবনা জেলার ভাঙ্গুড়া, চাটমোহর উপজেলা; সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, রায়গঞ্জ, উল্লাপাড়া (আংশিক) এবং নাটোরের সিংড়া, গুরুদাসপুর ও বড়াইগ্রাম উপজেলার ইতিহাস-ঐতিহ্য স্থান পেয়েছে। চলনবিল অঞ্চল নিয়ে সম্প্রতি উপন্যাস, লোক-ঐতিহ্য বিষয়ক (১৫০/২০০ পৃষ্ঠার) কিছু বই প্রকাশিত হয়েছে। কালের পরিক্রমায় অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়, হয় নতুন নতুন বিষয় ইতিহাসের সাথে যুক্ত। আর এ কারণেই ‘চলনবিল অঞ্চলের ইতিহাস’ গ্রন্থ রচনায় মনোনিবেশ করা। চলনবিল অঞ্চল বাংলাদেশের একটি জেলার আয়তনের সমান। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার চেয়ে বড়। তাই প্রথমে পাবনা জেলার চলনবিল এলাকা নিয়ে গ্রন্থ রচনার পরিকল্পনা করি। পাবনার ভাঙ্গুড়া ফরিদপুর ও চাটমোহরে ৫/৬ মাস ইউনিয়ন ভিত্তিক ফিল্ডওয়ার্ক করার পর লেখার কাজ শুরু করি। গতিধারা প্রকাশনীতে বইয়ের সফট কপি জমা দেওয়ার পর কাওসার ভাই বলেন, কষ্ট যখন করলেনই পুরা চলনবিল এলাকা নিয়ে কাজ করেন। এ কাজ তো বারবার হবে না। এমন কথা গতিধারার স্বত্বাধিকারী সিকদার আবুল বাশার (কাওসার ভাইয়ের বড়ভাই) ২০১৮ সালে একবার বলেছিলেন। তিনি আমাকে (ড. আশরাফ পিন্টুকে) চলনবিলের ইতিহাস (সাম্প্রতিক সময়ের তথ্যসহ) লিখতে বলেছিলেন। আমি বলেছিলাম, চলনবিল নিয়ে এম. এ. হামিদ সাহেবের বই তো রয়েছেই। তিনি বললেন, ওই বইটি তো ১৯৬৭ সালের লেখা। ইতিহাস একটি চলমান বিষয়। আজ থেকে ৫০/৫৫ বছর আগে বইটি লেখা হয়েছে। সময় অনেক গড়িয়েছে। ইতোমধ্যে অনেক নতুন উপাদান ইতিহাসের বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। রাধারমণ সাহার পর পাবনার ইতিহাসের বই আরো দুটি বের হয়েছে। তিনি চলনবিলের ইতিহাস রচনার পক্ষে যথেষ্ট জোরালো যুক্তি দাঁড় করালেন। তবু আমি বললাম, আমি অপারগ। কারণ চলনবিল একটা বিশাল অঞ্চল। একটা বড় জেলার সমান। এত বড় অঞ্চলে ফিল্ডওয়ার্ক করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। যা হবে না বলে ফেলে রেখেছিলাম, তাকে আবার পুনর্জীবিত করলেন কাওসার ভাই। চলনবিল অঞ্চলে রয়েছে তিনটি জেলার ১০টি উপজেলা, ৬১টি ইউনিয়ন ও ৭টি পৌরসভা। এ বিশাল এলাকায় ফিল্ডওয়ার্ক করা দুরূহ ব্যাপার। যদিও ইতোপূর্বে চাটমোহর, ফরিদপুর ও ভাঙ্গুড়ার প্রতিটি ইউনিয়নে ফিল্ডওয়ার্ক করেছি। যাহোক, বই সমৃদ্ধ করতে হলে কষ্ট স্বীকার করতে হবে। এ কথা মাথায় রেখেই আবার কাজ করা শুরু করলাম এবং এক সময় শেষও হলো। ইতিহাস-ঐতিহ্যে চলনবিল অঞ্চল একটি সমৃদ্ধ জনপদ। এখানে চাটমোহরের হা-িয়ালে রয়েছে দেশের অন্যতম প্রাচীন পুরাকীর্তি জগন্নাথ মন্দির। চাটমোহরের কাজিপাড়া, সমাজ; ভাঙ্গুড়ার চ-ীপুর ও গুরুদাসপুরের চাপিলায় রয়েছে মোগল আমলে নির্মিত শাহি মসজিদ, বৃগরিলায় রয়েছে প্রাচীন জামে মসজিদ। হা-িয়াল ও ভাঙ্গুড়ার ম-তোষ গ্রামে রয়েছে ‘শেঠের বাংলা’ ও ‘জোড়বাংলা’। অন্যান্য প্রাচীন ঐতিহ্যের মধ্যে রয়েছে হরিপুরের ‘জমিদার মন্দির’, কুমারগাড়ার বৈদ্যনাথ মন্দির’, শাহজাদপুরের পোতাজিয়ায় রয়েছে ধ্বংসপ্রায় ‘নবরতœ মন্দির’, হা-িয়ালের পাকপাড়ায় ‘এক গম্বুজ মসজিদ’ ও ‘বুড়াপিরের মাজার’, মূলগ্রামে উথুলীতে ‘শাহ চেতনের মাজার’, তাড়াশের নওগাঁয়ে রয়েছে হযরত শাহ শরিফ জিন্দানির মাজার ও মসজিদ, শিব ও গোবিন্দ মন্দির। চাটমোহরে রয়েছে মোগল/পাঠান আমলে খনিত ‘শীতলাই দীঘি’, ‘ময়দানদীঘি’, রায়গঞ্জের নিমগাছিতে রয়েছে ‘জয়সাগর’ ইত্যাদি।