তরুণ শিক্ষাবিদ, গবেষক ও প্রাবন্ধিক মোহাম্মদ আলী ইতিপূর্বে হেলাল হাফিজের কবিতা বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন। ‘সাতচল্লিশপরবর্তী বাংলাদেশের কবি ও কবিতা’ শিরোনামের এই দ্বিতীয় গ্রন্থে তার দৃষ্টি সামগ্রিকতার অভিমুখে পরিচালিত। তিনটি প্রবন্ধে মূলত কবিতার বিচার-বিশ্লেষণই মুখ্য। প্রথম প্রবন্ধে সাতচল্লিশপরবর্তী বাংলাদেশের কবিতার স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত করতে গিয়ে প্রাবন্ধিক আমাদের কবিতার মৌলিক দিকগুলি শনাক্ত করার প্রচেষ্টা চালান। বস্তুত দেশভাগের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যকার একই ভাষানির্ভর দুটি অংশের সাহিত্যও পৃথকতামণ্ডিত হয়ে যায়। বিশেষ করে তখনকার পূর্ববঙ্গের সাহিত্যকে নিয়োজিত হতে হয় অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামেও। ফলে আামাদের কবিতার প্রধান অভিমুখ ছিল জাতীয়তাবাদের চেতনা-শরণ। নম্র-মুগ্ধ-কোমল কবিতার সমান্তরালে আত্মচেতন দৃঢ়ভাষী কবিতার অভিযাত্রা সাতচল্লিশপরবর্তী কবিতা-স্বাক্ষর। মোহাম্মদ আলী সেই স্বাক্ষরের স্বকীয়তা নির্ণয় করেছেন বহুসংখ্যক কবিকণ্ঠের কাব্য প্রকাশের দৃষ্টান্তের সহযোগে। শিরোনামে সাতচল্লিশপরবর্তী হলেও শুরুর বিবেচনাকে তিনি শেষের প্রলম্বিত সীমানায় প্রায় সাম্প্রতিকতার উপকণ্ঠে এনে দাঁড় করান। ফলে সুদীর্ঘকালের বাংলাদেশের কবিতার একটা সামগ্রিক পরিচিতি আমরা পাই। দ্বিতীয় প্রবন্ধটিতে সত্তর দশকের বাংলাদেশের কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের প্রতিফলনের স্বরূপটি নিরূপণ করেছেন মোহাম্মদ আলী। আসলে বাংলাদেশের কবিতার ইতিহাসে সত্তর দশক এবং মুক্তিযুদ্ধ প্রায় সমার্থকতা অর্জন করেছে বলা যেতে পারে। সত্তরের কবিতায় যে উত্তাপ, প্রাখর্য আর তারুণ্যবহ্নি সেটিই সদ্য-স্বাধীন সার্বভৌম হওয়া বাংলাদেশের অন্তরাত্মার উদ্গম। মুক্তিযুদ্ধ যে আমাদের ইতিহাসের এবং সাহিত্যের এক নতুন বাস্তবতা সেই সত্যটি মনে রাখেন প্রবন্ধকার। মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবতায় যে দেদীপ্যমানতা ও অহংকারের আত্মপ্রকাশ সেটি বাংলাদেশের কবিতাকে একটি অনন্য ফ্রেমে বাঁধাই করে রাখে। মোহাম্মদ আলীর বিশ্লেষণে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় কাব্যিক প্রকাশটি সঠিকভাবে নির্ণীত হয়। গ্রন্থের সর্বশেষ প্রবন্ধটিতে বিশ্বের নানা দেশ-মহাদেশের কবিদের লেখা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কবিতার বিভিন্ন দিক বিশ্লেষিত হয়েছে। একইসঙ্গে এশিয়া-আফ্রিকা কিংবা লাতিন আমেরিকার মতো ভূখণ্ডের দেশগুলিতে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইয়ে কবিতা কী করে একটি সমান্তরাল শক্তির উৎস হয়ে আসে সে বিষয়টি ধরার অধ্যবসায় প্রবন্ধকারের রচনায় সুস্পষ্ট। মোটকথা তিনটি প্রবন্ধের সমন্বয়ে বোদ্ধা পাঠক সমালোচক-গবেষক মোহাম্মদ আলীর একটি পরিশ্রমী সচেতন সমালোচক-মানসের দেখা পাবেন। মহীবুল আজিজ [কবি, প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক]
মোহাম্মদ আলী কক্সবাজার জেলার ঈদগাঁও উপজেলার নাশিখাল ও ছোট্ট ফুলেশ্বরী নদীর রহস্য খুঁজে বেড়ানো শৈশব মোহাম্মদ আলীর। তাঁর গ্রামের নাম জাগির পাড়া। তিনি বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। লেখালেখির জগতে পরিচিত নন, আবার এক লাফে শিখরে যেতেও অনাগ্রহী। আগাতে চান ধীরে ধীরে, চিন্তার পরিচয়ে। চলার পথে তাঁকে নান্দনিক সব বিষয় টানে। তবে কবিতার সাথে গৃহস্থালী শৈশবের নীল সমুদ্র থেকে। প্রত্যাহিক জীবনের অন্যতম প্রধান খোরাক কবিতা, তাই তো ছাত্রজীবনের পর শিক্ষকতার অ্যাকাডেমি প্রয়োজনের তালিকাতেও কবিতার ব্যবচ্ছেদকে অগ্রণী ভূমিকাতে রাখছেন। নানামুখী শৈল্পিক সৌকর্যের কবিতায় নিয়মিত আগ্রহ বোধ করেন। প্রকাশিত প্রবন্ধ ‘ফুল ও ফুলকি’ (২০২৩, দিব্যপ্রকাশ) ও ‘সাতচল্লিশপরবর্তী বাংলাদেশের কবি ও কবিতা’ (২০২৩, দ্বিমত)।