দুআ মুমিনের হাতিয়ার। হাতিয়ার যত শক্তিশালী হবে, মুমিন ততবেশি নিরাপদ থাকবে। দুআই পারে তাকদিরকে পাল্টে দিতে। দুআর মাধ্যমেই আসে সফলতা। ইহকালে ও পরকালে কামিয়াব হওয়ার জন্যে দুআর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু কোন শব্দ দিয়ে আমরা আল্লাহর কাছে দুআ করব? কোন বাক্য দিয়ে তাঁর প্রশংসা করব? কিভাবে চাইলে আল্লাহ তাআলা আমাদের ডাকে সাড়া দেবেন? কোন শব্দগুলো দিয়ে দুআ করলে ফেরেশতারাও ‘আমিন-আমিন’ বলবেন? এইসব প্রশ্নের সমাধান নিয়ে “দারুল ফালাহ” প্রকাশ করেছে “দুআ বিশ্বকোষ”। বইটিতে দুআ ও যিকিরের পাশাপাশি রয়েছে বিভিন্ন আমল, ওজিফা, দরুদ ও ফজিলতের এক বিশাল ভাণ্ডার। রঙিন হরফ, আরবি ইবারত ও সহজ অনুবাদে দুআগুলো আনা হয়েছে। নবীন-প্রবীণ সব পাঠকের জন্যেই বইটি উপকারী হবে ইন-শা-আল্লাহ। কিতাবটির বৈশিষ্ট্য : ১. বইটিতে দুআ ও শিরোনামগুলো রঙিন হরফে দেওয়া হয়েছে। পাঠক দেখামাত্রই বুঝে যাবেন, কোনটি দুআ। এতে আমল করা ও মনে রাখা সহজ হবে ইন-শা-আল্লাহ। ২. দুআর আদব, দুআ কবুলের স্থান ও সময়, দুআ কবুল না হওয়ার কারণ-সহ সামগ্রিক বিষয় এতে স্থান পেয়েছে। ৩. প্রতিটি দুআর সাথে রয়েছে প্রেক্ষাপট। এতে করে দুআটি কোন উদ্দেশ্যে এবং কোন ঘটনাকে সামনে রেখে নবি সা. বর্ণনা করেছেন, সেটা জানা যাবে। ৪. বিপদ-মুসিবত, ডিপ্রেশন, ক্যারিয়ার-সহ জীবনঘনিষ্ঠ প্রচুর দুআ উল্লেখ করা হয়েছে। জীবন চলার পথে বইটি গাইডলাইন হিসেবে কাজ করবে ইন-শা-আল্লাহ। ৫. কোন কোন পদ্ধতিতে দরুদ পড়া যায়, কোন সূরার কী ফজিলত রয়েছে, কোন কোন মাসে কী কী মাসনুন আমল করতে হয়, ইত্যাদি বিষয় হাদীস থেকে উল্লেখ করা হয়েছে। ৬. বিভিন্ন আমলের পাশাপাশি রয়েছে মাসনুন ওজিফা। প্রিয়নবি সা. কোন সময়ে কোন ওজিফা পালন করতেন, সেটিও বর্ণনা করা হয়েছে সহীহ হাদীসের আলোকে। ৭. বইটির আরবি ও বাংলা ফন্ট সবার জন্যেই পাঠসাধ্য। ৮. পুরো বইতে প্রায় ১২০০ দুআ ও যিকির রয়েছে। যাকেরীনদের জন্যে এটি একটি বিশাল হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে ইন-শা-আল্লাহ। ৯. তিনটি ক্ল্যাসিক্যাল বই সামনে রেখে বিশ্বকোষটি সংকলন করা হয়েছে। ইমাম নববির “আল-আযকার”, ইবনুল জাযারির “হিসনে হাসীন” এবং সাঈদ আল-কাহতানির “আদ-দুআ ওয়ায যিকির ওয়াল ইলাজ বির রুকা”। রাহিমাহুমুল্লাহ। এছাড়া কাজ করতে গিয়ে আরোও প্রায় ২৮-৩০ টি প্রন্থের সহায়তা নেয়া হয়েছে।
তাঁর পূর্ণনাম মুহিউদ্দ্বীন আবু যাকারিয়া ইয়াহইয়া ইবনুশ শায়েখ আবু ইয়াহইয়া মুররি ইবনে হাসান ইবনে হুসাইন ইবনে মুহাম্মদ ইবনে জুম‘আ ইবনে হেযাম আল-হেযামী আন-নববী। ‘মুহিউদ্দ্বীন’ তাঁর উপাধি এবং ‘আবু যাকারিয়া’ হলো কুনিয়াত তথা উপনাম। তাঁর জীবদ্দশায় তিনি এতোটাই প্রসিদ্ধ ছিলেন এবং ইলম ও তাক্বওয়ার মানদণ্ডে এমন সমুন্নত হতে পেরেছিলেন যে, তাঁকে ‘মুহিউদ্দ্বীন মতান্তরে ‘মুহিউস্ সুন্নাহ’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ৬৩১ হিজরীর মুহাররম মাসে দামেশকের নিকটবর্তী ‘নাওয়া’ নামক স্থানে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। জন্মস্থানের দিকে সম্পর্কিত করেই তাঁর নামের শেষে ‘নাওয়ায়ী’ বা ‘নববী’ উল্লেখ করা হয়। এ ব্যাপারটা স্বতঃসিদ্ধ ও প্রমাণিত যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর যেসব বান্দাদের দিয়ে দীন ও মানুষের মহান খেদমত করান, ছোটবেলা থেকেই তাদেরকে সেভাবেই গড়ে তোলেন। ইমাম নববী রাহিমাহুল্লাহ’র ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। শৈশবে থেকেই তিনি ছিলেন আর সব শিশুদের চেয়ে আলাদা। অজপাড়া গ্রামে, নিম্নবিত্ত নিরক্ষর পরিবারে জন্ম নেওয়া সত্তে¡ও তাঁর সবটুকু ঝোঁক ছিলো ইলম অর্জনের দিকে। দোকানদার পিতা চাইতেন, ছেলে তার সাথে দোকানদারী করুক। কিন্তু তিনি পিতার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে দামেশকের ‘আর-রাওয়াহিয়্যাহ’ নামক প্রতিষ্ঠানে চলে যান ইলমের-অšে¦ষণে এবং আলেমদের সংস্পর্শে থাকার তাড়নায়। এখানে থেকেই তিনি ইলমের সবগুলো শাখায় নিজের উত্তরোত্তর ব্যুৎপত্তি ঘটান। ইমাম যাহাবী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘তিনি (নববী) দিন-রাত্রির বেশির ভাগ সময় জ্ঞানার্জনে ব্যয় করতেন। মেধা ও পরিশ্রমের জন্য তাঁকে দিয়ে উদাহরণ পেশ করা হতো।’ সারাদিনে একবার খেতেন। এমনকি পথ চলার সময়টুকুতেও মনে মনে পড়া আওড়াতেন। ৬৫১ হিজরীতে একুশ বছর বয়সে তিনি পিতার সাথে হজ্জ পালন করার জন্য মক্কায় যান। এই সফরকালে তিনি মক্কা-মদীনার শ্রেষ্ঠ আলেমগণের সান্নিধ্যে আসেন এবং হাদীস শাস্ত্রে বিশেষ বুৎপত্তি অর্জন করেন। ইমাম নববী রাহিমাহুল্লাহ যেসব ওস্তাদদের নিকট থেকে জ্ঞানার্জন করেছেন, তাঁদের মধ্যে মুহাম্মদ ইবনে আহমাদ আল-মাকদাসী, ইসমাইল ইবনে ইবরাহীম, আহমদ ইবনে আবদুদ্দায়েম, আবদুর রহমান আল-আন্বারী, ইবরাহীম ইবনে আলী আল-ওয়াসেতী প্রমূখ অন্যতম। ফিকহের ক্ষেত্রে নববী ছিলেন শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী। শুধু অনুসারীই নয়, বরং তিনি ছিলেন মাযহাবের প্রধান বিশ্লেষক ও ইমামদের একজন। ইবনে কাসীর রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘তিনি ছিলেন শায়খুল মাযহাব এবং তাঁর যমানার শ্রেষ্ঠতম ফকীহ’। যাহাবী বলেন, ‘তিনি ছিলেন মাযহাবের ব্যাখ্যাকারদের শিরোমনি’। তাঁর রচিত ‘রাওদাতুল ত্বালেবীন’কে শাফেয়ী মাযহাবের প্রধানতম ব্যাখ্যাগ্রন্থ ও তথ্যসূত্র হিসেবে গণ্য করা হয়। অধিকাংশ শাফেয়ী আলেমদের মতো ইমাম নববী রাহিমাহুল্লাহও আকীদার ক্ষেত্রে ‘আশ‘আরী’ মতবাদের অনুসারী ছিলেন। যাহাবী, তাজউদ্দীন সুবকী, ইয়াফেয়ী-সহ তাঁর অপরাপর জীবনীকাররা এমনটাই উল্লেখ করেছেন। সহীহ মুসলিমের ব্যাখ্যায় তাঁর রচিত ‘আল মিনহাজ’ গ্রন্থে তিনি আশ‘আরী মতবাদসমূহকে ব্যাপকভাবে স্থান দিয়েছেন। ক্ষণজন্মা এই মহাত্মা বেঁচে ছিলেন মাত্র পয়তাল্লিশ বছর। কিন্তু এই স্বল্প সময়েও আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁকে দিয়ে দীন ও ইলমের যে বিশাল খেদমত করিয়েছেন, তা সত্যিই বিরল। ইলমের প্রায় প্রতিটি শাখাতেই তাঁর রচিত গ্রন্থ রয়েছে, যেগুলো কেয়ামত পর্যন্ত মানুষকে উপকার দিয়ে যাবে, ইনশাআল্লাহ! বিশেষ করে ‘আল-আরবাঈন আন-নববীয়্যাহ’, ‘রিয়াদুস সালেহীন’ এবং ‘আল-আযকার’ এই তিনটি গ্রন্থ তো সর্বস্তরের মুসলিমের কাছেই সমানভাবে সমাদৃত এবং পঠিত। এছাড়া তাঁর রচিত বিখ্যাত গ্রন্থাবলির মধ্যে অন্যতম হলো, (১) আল-মিনহাজ ফি শারহে মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ; (২) রাওদাতুল ত্বালেবীন ওয়া উমদাতুল মুফতীন; (৩) মিনহাজুল ত্বালেবীন ওয়া উমদাতুল মুফতীন; (৪) আদাবুল মুফতি ওয়াল মুসতাফতি; (৫) তুহফাতু তুল্লাবিল ফাদায়েল; (৬) আত-ত্বিবইয়ান ফি আদাবে হামালাতিল কুরআন। (৭) আত-তাহরীর ফি আলফাযিত তানবীহ; (৮) আল-উমদাহ ফি তাসহিহিত তানবীহ; (৯) আল ইদ্বাহ ফিল মানাসিক; (১০) আত তাইসীর ফি মুখতাসারিল ইরশাদ; (১১) ইরশাদু তুল্লাবিল হাক্বায়েক; (১২) আল-ফাতাওয়া; (১৩) আল মিনহাজ ফি মুখতাসারিল মুহাররার; (১৪) দাকায়েকুল মিনহাজ; (১৫) মুখতাসারু আসাদিল গাবাহ; (১৬) মানাকিবুশ শাফেয়ী; (১৭) মুহেম্মাতুল আহকাম; (১৮) রিসালাহ ফি ক্বিসমাতিল গানাঈম; (১৯) খুলাসাতুল আহকাম; (২০) বুসতানুল আরেফীন। এছাড়া তাঁর রচিত অসমাপ্ত গ্রন্থের সংখ্যাও কম নয়। তন্মধ্যে ‘আল মাজুমু শারহুল মুহায্যাব’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর মৃত্যুর পর ইমাম সুবকী রাহিমাহুল্লাহ এবং তারপর শায়েখ মুহাম্মদ নজীব এই গ্রন্থের রচনা সমাপ্ত করেন। এছাড়া ‘জামেউস সুন্নাহ’, ‘শারহুত ত্বানবীহ’, ‘শারহুল ওয়াসিত’, ‘শারহুল বুখারী’, ‘শারহু সুনানি আবু দাউদ’, ‘আল-আহকাম’ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। ৬৭৬ হিজরীর রজব মাসের চব্বিশ তারিখে পয়তাল্লিশ বা ছেচল্লিশ বছর বয়সে এই মনীষী ইন্তেকাল করেন। তাজউদ্দীন সুবকী রাহেমাহুল্লাহ বলেন, ‘তাঁর মৃত্যুতে দামেশক ও তদ্সংলগ্ন শহরগুলো শোকে ডুবে গিয়েছিলো।’ জন্মস্থান ‘নাওয়া’তেই তাঁকে দাফন করা হয়। মহান আল্লাহ তাঁকে এবং তাঁর সকল খেদমতকে কবুল করুন।