উপন্যাসের আরম্ভটা পাঠককে ঝাকিয়ে দেয়। বাহত মৃত হারু ঘোষ জঙ্গলের প্রান্তে খালের ধারে একটা গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছিল, ঠিক যেভাবে বজ্রপাতের আগের মুহূর্তে সে গাছের তলায় বৃষ্টি থেকে আড়াল পাবার জন্য দাঁড়িয়েছিল। দুর্ঘটনায় মৃত্যু, তবে যেভাবে লেখক বর্ণনা করেছেন বিমূঢ় হতে হয় তাতে— বটগাছের ঘন ছায়ায় বেশিক্ষণ বৃষ্টি আটকাইল না। হারু দেখিতে দেখিতে ভিজিয়া উঠিল। স্থানটিতে ওজনের ঝাঁঝালো সামুদ্রিক গন্ধ ক্রমে মিলাইয়া আসিল। অদূরের ঝোপটির ভিতর হইতে কেয়ার সুমিষ্ট গন্ধ ছড়াইয়া পড়িতে আরম্ভ করিল। সবুজ রঙের সরু লিকলিকে একটা সাপ একটি কেয়াকে পাকে পাকে জড়াইয়া ধরিয়া আচ্ছন্ন হইয়া ছিল। পায়ে বৃষ্টির ভাল লাগায় ধীরে ধীরে পাক খুলিয়া ঝোপের বাহিরে আসিল। ক্ষণকাল স্থিরভাবে কুটিল অপলক হারুর দিকে চাহিয়া থাকিয়া তাহার দুই পায়ের মধ্য দিয়াই বটগাছের কোটরে অদৃশ্য হইয়া গেল। হারুর স্থায়ী নিস্পন্দতায় সাহস পেয়ে একটি কাঠবিড়ালি গাছের উঁচু ডাল থেকে নিচে নেমে এল, গিরগিটি পোকা ধরার কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠল। এবং মরা শালিকের বাচ্চাটিকে মুখে করিয়া সামনে আসিয়া ছপছপ করিয়া পার হইয়া যাওয়ার সময় একটা শিয়াল বারবার মুখ ফিরাইয়া হারুকে দেখিতে লাগিল। ওরা টের পায়। কেমন করিয়া টের পায় কে জানে? একটা মানুষের নৈসর্গিক দুর্ঘটনায় মৃত্যু এবং তাকে ঘিরে প্রকৃতিতে প্রাণলোকে বিকারে-নির্বিকারে প্রতিক্রিয়ার এই ছবি যেন নব্য কবিতার ইমেজারি। কিন্তু এই পর্যন্ত। বড় জোর মানবলোকে এই মৃত্যু নিয়ে যে অনুচ্ছ্বসিত মমতার স্পর্শ তার সঙ্গে মিলে প্রসঙ্গটি সমে এসে থামল। ওদিকে পাঠকের মনে প্রত্যাশা জাগে উপন্যাসে এই ঘটনার গুরুতর প্রভাব পড়বে। হারুর মেয়ে মতি, পুত্র পরাণ, পুত্রবধূ কুসুম উপন্যাসের মুখ্য পাত্রপাত্রীর মধ্যে পড়ে। কিন্তু হারুর মৃত্যুশোককে লেখক দিন সাতেকের বেশি স্থায়ী করেননি। এমন একটা ব্যাপার তৈরি করেও তাকে কাজে লাগালেন না লেখক।
শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, মধ্যবিত্ত সমাজের কৃত্রিমতা, নিয়তিবাদ ইত্যাদি বিষয়কে লেখার মধ্যে তুলে এনে বাংলা সাহিত্যে যিনি অমর হয়েছেন, তিনি হলেন প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯০৮ সালের ১৯ মে বিহারের সাঁওতাল পরগনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, আর মানিক ছিলো তাঁর ডাকনাম। বাবার বদলির চাকরিসূত্রে তাঁর শৈশব, কৈশোর ও ছাত্রজীবন কেটেছে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে, যার ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের পটভূমিতে বিভিন্ন সাহিত্য রচনা করেছেন তিনি। প্রবেশিকা ও আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় গণিত বিষয়ে অনার্স করতে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এখানে পড়াশোনাকালে বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে তিনি 'অতসী মামী' গল্পটি লেখেন। সেই গল্পটি বিখ্যাত 'বিচিত্রা' পত্রিকায় ছাপানো হলে তা পাঠকনন্দিত হয় এবং তিনি সাহিত্যাঙ্গনে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি সাহিত্য রচনায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন, যার ফলে তাঁর পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং তিনি আর পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। তাঁর হাতে বাংলা সাহিত্যে এক বৈপ্লবিক ধারা সূচিত হয় ঐ সময়ে, যখন সারা পৃথিবী জুড়ে মানবিক বিপর্যয়ের এক চরম সংকটময় মুহূর্ত চলছে। কমিউনিজমের দিকে ঝুঁকে যাওয়ায় তাঁর লেখায় একসময় এর ছাপ পড়ে এবং মার্ক্সীয় শ্রেণীসংগ্রাম তত্ত্ব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র। ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণেরও প্রভাব লক্ষ্য করা যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র-তে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে 'পদ্মানদীর মাঝি', 'দিবারাত্রির কাব্য', 'পুতুলনাচের ইতিকথা', 'শহরতলি', 'চতুষ্কোণ', 'শহরবাসের ইতিকথা' ইত্যাদি বিখ্যাত উপন্যাস, এবং 'আত্মহত্যার অধিকার', 'হারানের নাতজামাই', 'বৌ', 'প্রাগৈতিহাসিক', 'সমুদ্রের স্বাদ', 'আজ কাল পরশুর গল্প' ইত্যাদি গল্পগ্রন্থ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা রচনার কিছু নিদর্শন থাকলেও সেগুলো তেমন উল্লেখযোগ্যতা অর্জন করেনি। অসামান্য এই কথাসাহিত্যিক মাত্র ৪৮ বছর বয়সে ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।