ভূমিকা ও আলোচনা তিতাস একটি নদীর নাম ঃ কৌম সময়ের আখ্যান ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তিতাস নদীর পারে গোকর্ণ গ্রামের মালোপাড়ায় কৌম আবহ থেকে অদ্বৈত মল্লবর্মণের জজীবন-মনন-কল্পনা উৎসারিত হয়েছিল। অজস্র বৈরিতার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে ক্রমশ নিজের জীবনের আখ্যানও গড়ে তুলছিলেন তিনি। পর্যায়ক্রমে তাঁর চারণভূমি ও মানসিক প্রেক্ষিতের পরিসর বিস্তৃততর হলো। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে কুমিল্লা এবং কুমিল্লা থেকে কলকাতায় এলেন অদ্বৈত। জীবন সংগ্রামের প্রয়োজনে পুনর্বিন্যস্ত হলো অর্থাৎ সংগ্রামই রচনা করল তাঁর জীবনের আখ্যান। অন্তত কুড়ি বছর বয়স পর্যন্ত কৌম আবহ শারীরিকভাবেও সংলগ্ন ছিল তাঁর। তারপর ওই শারীরিক সংলগ্নতা রইল না। কৌম জীবনের অনুষঙ্গগুলি হয়ে উঠল স্মৃতির গ্রন্থনা শুধু। কলকাতায় জীবন ধারণের সংগ্রাম শুরু হওয়ার এগারো বছর পর ব্যক্তি-জীবন ও সামূহিক জীবনের দ্বিবাচনিকতাকে ভিত্তি করে অদ্বৈত যখন মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায় "তিতাস একটি নদীর নাম'-এর আদিরুপটি লিখছিলেন, কৌম স্মৃতিতে আধারিত হলো আখ্যান। মহানগরের বিপরীত মেরুর অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও কৌম সময়ের অনুপুঙ্খ গ্রন্থনা সম্ভব হলো তাঁর পক্ষে; কেননা তিনি দৈনন্দিন জীবনে উপলব্ধি একক ও সামূহিক অভিজ্ঞতাকে দেখছিলেন দ্বিবাচনিক অপরতার দর্পণে। সময় যদিও অবিভাজ্য, বিভিন্ন আধারে প্রতিবিম্বিত হয়ে তা বেশ কিছু খণ্ডকালের একক হিশেবে আমাদের কাছে পৌঁছায়। নির্বিশেষ সময় বিশেষ ঐতিহাসিক পর্যায়ে ও বিশেষ গোষ্ঠির অভিজ্ঞতায় বিধৃত হয়ে স্বতন্ত্র চরিত্র অর্জন করে নেয়। তিতাস পারে যাদের অবস্থান, সেই মালোদের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। বিশেষ কৌম বাস্তবতার ধারক হিসেবে এই উপন্যাসে সময়ও যেন কৌম চরিত্র অর্জন করে নিয়েছে। অদ্বৈত মল্লবর্মণের কথকসত্তা সক্রিয় পর্যবেক্ষক হয়ে আখ্যানে সূত্রধার হিসেবে উপস্থিত। "তিতাস একটি নদীর নাম' উপন্যাসের বয়সে স্তরে স্তরে এসেছে যে ব্যক্তি অস্তিত্বকে কখনও খুব নিয়ামক বলে মনে হয় না। এমন কি অনন্তের মতো গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রও নয়। উপন্যাসের বিভিন্ন পর্বে ভিন্ন ভিন্ন কুশীলবেরা সময়েরই বার্তা বয়ে এনেছে। সবমিলিয়ে গড়ে উঠেছে কৌম জীবন সংশ্লিষ্ট সময়বোধের সামুহিক বাচন। এই উপন্যাস পড়তে পড়তে আমাদের মনে এই প্রত্যয় দৃঢ় প্রতিষ্ঠা লাভ করে যে আমাদের জীবন মূলত আখ্যানের পরম্পরা মাত্র। আর, এই আখ্যান মূলত সময় চিহ্নিত। এতে বর্তমানের হৃদস্পন্দনে সম্পৃক্ত থাকে কৌম অতীত এবং সেই সঙ্গে সম্ভাব্য ভবিষ্যৎও । অদ্বৈত মল্লবর্মণ স্পষ্টত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে নৈর্ব্যাক্তিকের পদবী নিয়েছেন। বিপুল মানব-প্রবাহে যারা পুরোপুরি অন্তেবাসী, সেই নিম্নবর্গীয় জনপদের সামুহিক জীবনের ধারাবাহিকতাকে আখ্যানে রূপান্তরিত করে তিনি মানবিক সময়ের ইতিবাচক ও নেতিবাচক সম্ভাবনা মূর্ত করে তুলেছেন। কৌম বাস্তবের নানান অনুষঙ্গ থেকে ঔপন্যাসিকতার সূত্র আহরণ করে তিনি আখ্যান ও জীবনের যুগলবন্ধি রচনা করেছেন। শেষ পর্যন্ত গড়ে উঠেছে এক নতুন বাস্তবতা, এক নতুন পুনর্বিন্যস্ত পৃথিবী।
জন্ম ১৯১৪ সালের ১ জানুয়ারি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গােকর্ণ গ্রামে এক মৎস্যজীবী পরিবারে। শৈশবেই মাতৃপিতৃহীন। ১৯৩৩ সালে স্থানীয় অন্নদা। এইচ. ই. স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর অর্থোপার্জনের জন্য কলকাতায়। গমন। পেশাগত জীবনের শুরু ত্রিপুরা পত্রিকায়। এরপর সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেন নবশক্তি, মাসিক মােহাম্মদী, নবযুগ, আজাদ, কৃষক পত্রিকা ও সাময়িকীতে।। উপন্যাস তিতাস একটি নদীর নামতার স্মরণীয় সাহিত্যকীর্তি। আরভিং স্টোনের উপন্যাস লাস্ট ফর লাইফ-এর বাংলা । অনুবাদ তার আরও একটি উল্লেখযােগ্য সাহিত্য প্রয়াস। মৃত্যু ১৬ এপ্রিল, ১৯৫১।