‘নৈঃশব্দ্যের নিনাদ’ বইটিতে মোট এগারোটি গল্প স্থান পেয়েছে। প্রতিটি গল্পের বিষয়বস্তু ও উপস্থাপনভঙ্গীতে রয়েছে ভিন্নতা। * নৈঃশব্দ্যের নিনাদঃ সময়ের পরিক্রমায় একমাত্র ছোট ভাই রতনকে নিয়ে এক অসম জীবনযুদ্ধে সামিল হয় মাত্র বারো বছরের কিশোর কলিম। কোনো এক অলৌকিক উপায়ে অর্জন করে মায়ের অন্তিম সময়ের ভারী দেহটিকে বহন করার শক্তি। দিগন্তবিস্তৃত বিলে থৈ-থৈ জলরাশির মাঝখানে কাঁচা রাস্তাটায় সৃষ্টি হওয়া খাদের ওপারে মায়ের নিষ্প্রাণ দেহটি নিয়ে আটকে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। জনশূন্য নিরব নিস্তব্ধ পরিবেশে সদ্য শৈশব পেরুনো কলিম গভীরভাবে উপলব্ধি করে- এই নির্মম পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে কারো উপর নির্ভরশীল হওয়া চলবে না। যে করেই হোক মায়ের লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে, এখন থেকে একমাত্র ছোটো ভাই রতনের দায়িত্ব তাকেই নিতে হবে। সেই জনশূন্য ও জলবেষ্টিত ভাঙা রাস্তাটির উপর মায়ের লাশ নিয়ে অপেক্ষার দীর্ঘ মুহূর্তগুলোতে কলিম ও রতনের বুকের ভিতরের নৈঃশব্দের নিনাদ কেউ শুনতে পায় না। * নাটাই ছেঁড়া ঘুড়িঃ শেকড় ছেঁড়ার কষ্টটা খোকার শিশুমনে গভীরভাবে দাগ কেটে যায়। আজ বাবাকে ফেলে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে খোকা। এতটা দূরে যে চাইলেই যখন তখন তাঁর কাছে ছুটে যেতে পারবে না। নাটাই থেকে সূতো ছেঁড়া ঘুড়ির মতো উড়ে চলেছে সম্পুর্ণ আজানা অচেনা পরিবেশে, যেখানে কেউ ওকে চেনে না। জন্মের পর মাকে হারানোর কষ্ট, প্রিয় গ্রাম থেকে দূরে থাকার কষ্ট, বাবাকে দেখতে না পাওয়ার খোকার কষ্টগুলো রাতের অন্ধকারের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। * চেনা পথের বাঁকেঃ ভালোবাসা কখন কোন পথে জীবনে আসে কেউ বলতে পারে না। শান্তনা উপলব্ধি করে শৈশবের খেলার সাথি সত্যেন তার জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। স্বজনেরা সবাই স্বদেশ ত্যাগ করে চলে গেছে ওপারে, কিন্তু শান্তনা কিসের টানে যেন বাঁধা পড়ে যায়। তাইতো সামাজিক প্রতিকূলতা ও সত্যেনের নিস্পৃহতা সত্ত্বেও মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকে; খুঁজে ফেরে হারিয়ে ফেলা স্বর্নালি সময়গুলোকে তার চেনা পথের বাঁকে। * একলা চলার পথেঃ সেই চোখ, সেই মুখ- সারাক্ষণই যেন আচ্ছন্ন করে রাখে অনিরুদ্ধকে। তাইতো পরিচিতজনদের কাছ থেকে একরকম পালিয়ে বেড়ায় সে। একে একে বহু বসন্ত বিদায় নিয়েছে জীবন থেকে, কিন্তু কারো সাথে নিজেকে জড়াতে পারেনি সে। দশ বছর পর, একলা চলার পথে আচমকাই ট্রেনের কামরায় আবার আবিকাষ্কার করে নীলাকে। কিছুক্ষণের জন্য হলেও দু’জনে হারিয়ে যায় স্মৃতির ধূসর জগতে। * পেছন পথের ধুলোঃ চল্লিশ বছর পর ইমতিয়াজ সাহেব ওরফে লালু নতুন করে উপলব্ধি করলো সমাজে প্রতিষ্ঠা আর জনপ্রিয়তাই সফলতার মাপকাঠি নয়; জীবনে যত বড়ই হোক না কেন মানুষের অতীত কখনও মুছে যায় না। তাইতো ভাঙা কুঁড়েঘরে বসবাস করেও বাল্যবন্ধু গফুর আজ তাঁকে পাহাড়চূঁড়া থেকে এক ঝটকায় মাটির কাছাকাছি নামিয়ে চরম সত্যের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। * আবীর ও একটি হুইল চেয়ারঃ আবীর একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সারি সারি অট্টালিকার উপরে ধূ-ধূ মেঘে ঢাকা শামিয়ানাটার দিকে। চোখে ভর করে আছে এক অদ্ভুত শূন্যতা। বারান্দার গ্রিলের বাইরে খোলা মাঠে ফুটবল খেলছে বিভিন্ন বয়সী ছেলেরা। প্রতিদিনই সে হুইল চেয়ারে বারান্দায় বসে ওদেরর খেলা দেখে। আজ দু'দিন ধরে সেদিকে মন নেই। মাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। তার ভালোবাসার একমাত্র আশ্রয়। সারাক্ষণ মনে একটাই প্রশ্ন- ‘মা কেন আসছে না?’ * বেলা অবেলাঃ সোডিয়াম লাইটের হালকা আলোয় হাঁটতে হাঁটতে রঞ্জু ভাবে- ‘কত বিচিত্র মানুষের জীবন। কত ছোট খাটো কষ্ট নিয়েই আমরা বিমর্ষ হয়ে পড়ি, অথচ হরতালের মধ্যেও খেটে খাওয়া মানুষগুলো প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে চলে বেঁচে থাকার জন্য। প্রতিবন্ধী হলেও থেমে থাকে না তাদের এই জীবনযুদ্ধ। আমাদের সমাজে যারা বড় বড় কথা বলেন, জনদরদী বলে নিজেদের জাহির করেন তারা কি এইসব খেটে খাওয়া মানুষগুলোর কথা ভাবেন কখনও।’ * দূর আকাশের তারাঃ রাত তিনটা। অমিত পাশ ফিরে দেখে অহনা বিছানায় নেই। রোদেলার রুমে খুঁজে না পেয়ে বারান্দায় এসে দেখলো অহনা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আজ কত কথা মনে পড়ে যায় অহনার! রোদেলার যখন চার বছর বয়স, দুষ্টুমি করলে মেয়েকে সে বলতো ‘এমন করলে আমি মরে যাবো। ঐ দূর আকাশের তারা হয়ে যাবো। আমাকে আর খুঁজে পাবি না’। রোদেলা ছুটে এসে মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়তো, আর বলতো ‘তুমি মরে যেওনা আম্মু, আমি আর দুষ্টুমি করবো না’। আজ রোদেলা নেই। ওকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলো। * মূল্যঃ সালিস শেষ হয়ে গেলে একে একে সবাই চলে যায়। ছোট্ট ফাঁকা উঠোনটির মাঝখানে পাথরের মূর্তির মতো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে ফুলজান। সে বুঝলো, তার ময়নার জীবনের মূল্য মাত্র এক লাখ টাকা। গ্রামের মান্যগণ্য মানুষজন এই দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে, তার আর কিছুই বলার নাই। ময়নার একমাত্র স্মৃতিচিহ্ন ছোট্ট সুমন এসে হাত ধরে। ফুলজান ওকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘আমারে মাপ কইরা দিস ভাই, আমি তোর মা’রে বেইচা দিলাম, আমি আমার ময়নারে বেইচা দিলাম।’ * শেষ বেলার গল্পঃ একমাত্র ছেলে রওনকের সুখের কথা ভেবে রওশন আরা মেনে নেয় তার পড়ন্ত বেলার ভাগ্য। বৃদ্ধাশ্রমে যাওয়ার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ছেলের জন্য নিজের কক্ষে অপেক্ষা করে সে। কিন্তু ছোট্ট রাতুল তার দিদাকে কোথাও যেতে দিতে রাজি নয়। তার মনে প্রশ্ন- মানুষ বৃদ্ধ হয়ে গেলে তাকে ওল্ডহোমে চলে যেতে হবে? রওনক কি পারবে তার মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসতে? শিখা কি মেনে নিতে পারবে রওনকের সিদ্ধান্ত? এসব প্রশ্নের উত্তর রয়েছে- শেষ বেলার গল্পে। * অচেনা আগন্তুকঃ একটি খুন! যাত্রাদলের একজন নর্তকীও নিখোঁজ! সারা এলাকায় একটা থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছিলো। ঠিক এমন সময় আচমকা সেখানে হাজির হয় এক অচেনা আগন্তুক। গফুর দারোগা কি এই সুযোগ হাতছাড়া করবে? কিন্তু কোন যুক্তিতে লোকটিকে এরেস্ট করবে সে? তার বিরুদ্ধে তো কোনো অভিযোগ নেই! অভিনব কায়দায় লোকটিকে ফাঁদে ফেললো দারোগা। কমিশনার আফছার মন্ডলের বাড়িতে একরকম গৃহবন্দী করে রাখলো। অচেনা আগন্তুক জামিল আহসান কি আসলেই দোষী? নাকি খুনি নজু মিয়া, নাকি অন্য কেউ? উত্তর মিলবে ‘অচেনা আগন্তুক’ গল্পে।
জন্ম ১লা এপ্রিল, ১৯৭৪; বরিশাল জেলার জাগুয়া গ্রামে। কীর্তনখোলার তীর ঘেঁষে সবুজ শ্যামল গ্রামীন পরিবেশে বেড়ে ওঠা। শিক্ষাজীবন ও কর্মজীবন ঢাকায় কাটালেও গ্রামের প্রতি রয়েছে তাঁর প্রগাঢ় আকর্ষণ। গাঁয়ের মেঠোপথ, সবুজ বনানী আর কীর্তনখোলার ধূ-ধূ বালুচরে পার করা শৈশবের দুরন্তপনার দিনগুলো সময় অসময়ে তাঁকে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে। তাইতো তাঁর লেখনিতে বারবার উঠে এসেছে গাঁয়ের কথা, নদীর কথা; বহুমাতৃক জীবনালেখ্য তথা গ্রামীন জনজীবনের গল্পগাঁথা। প্রকাশিত গ্রন্থসমূহঃ উপন্যাস ‘ধূসর গোধূলি’ (২০১৬), মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গ্রন্থ ‘একাত্তরের বিদেশি সুহৃদ : দুঃসময়ের সারথি’ (২০২২), উপন্যাস ‘ফেরা’ (২০২৩), গল্প সংকলন গ্রন্থ ‘নৈঃশব্দ্যের নিনাদ’ (২০২৩), উপন্যাস ‘চোরকুঠুরি প্রথম খণ্ড’ (২০২৪), গল্প সংকলন গ্রন্থ ‘নীল জোনাকির গল্প’ (২০২৪), কিশোর উপন্যাস ‘নিঝুমপুরে একরাত্রি’ (২০২৫), গল্প সংকলন গ্রন্থ ‘রুপালি ছায়াবীথি’ (২০২৫), অণুকাব্য গ্রন্থ ‘অনুপদী’ (২০২৫) প্রকাশের তালিকায় রয়েছে আরও একাধিক গ্রন্থ- উপন্যাস ‘চোরকুঠুরি ২য় খণ্ড’ কাব্যগ্রন্থ ‘মগ্ন চৈতন্যের কাব্য’ উপন্যাস ‘সুখপাখি’ ও উপন্যাস ‘তিন অধ্যায়’ একক গ্রন্থ ছাড়াও বিভিন্ন সাহিত্য সংকলন গ্রন্থে তার বেশকিছু গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ ও ভ্রমণ কাহিনি স্থান পেয়েছে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকা ও বাংলা ব্লগে লেখালেখি করছেন। ব্যবস্থাপনা বিষয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে লেখক একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে দীর্ঘদিন চাকুরিরত ছিলেন। বর্তমানে নিজস্ব ব্যবসা পরিচালনার কাজে নিয়োজিত।