নব্বই দশক থেকে আজ অবধি মানুষের মুখে মুখে ফেরা অসংখ্য জনপ্রিয় গান ও কবিতার কবি লতিফুল ইসলাম শিবলী’র চতুর্থ কাব্যগ্রন্থে এসে তার কবিতার এক বিস্ময়কর পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। তিনি আকণ্ঠ ডুবে আছেন প্রেমে, এই প্রেম জাগতিক নয়- আধ্যাত্মিক। সৃষ্টিকর্তাকে ভালোবেসে তার পুরো সৃষ্টি জগতের প্রতি তার প্রেম। সে প্রেম এমনই বেপরোয়া যে তিনি অবলীলায় বলতে পারেন – ‘একটা জীবন দিয়েও যদি তোমায় আমি পেলাম, তবে বড় অল্প দামেই পেলাম।‘ তাত্ত্বিক-গভীর অনুভূতিগুলি অত্যন্ত সহজ সরল ভাষায় তিনি প্রকাশ করেছেন কবিতায়।সেসব কবিতা তাকে নিয়ে গেছে গণমানুষের কাছে। ফিলিস্তিনের হুইলচেয়ারে বসা সেই মহান শহিদ যোদ্ধা ‘ফাদি আবু সালাহ’ কে শিবলী’র কবিতার ভিতর দিয়ে এদেশের মানুষ স্মরণীয় করে রেখেছে। মধ্যযুগের মধ্য এশিয়ান সুফিদের মরমিবাদের খুশবু মেলে তার কবিতায়- ‘যুগোপযোগী হওয়া বন্ধু আমার কর্ম নয়, যুগ কে বানাবো আমার উপযোগী জেনে রেখো নিশ্চয়।‘ তার কবিতায় অধ্যাত্ববাদ রূপান্তরিত হয়েছে- দ্রোহে। আল্লাহর প্রেমে সারা বিশ্বজুড়ে নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের পক্ষে বুক চেতিয়ে দাঁড়িয়ে তিনি দিয়েছেন ‘মানুষ’ এর নতুন সংজ্ঞা- ‘যতক্ষণ তুমি ইনসাফের পক্ষে শুধু ততক্ষণই তুমি মানুষ।‘
কয়েকটি গানের টাইটেল বললেই শিবলীকে চেনা সহজ, যেমন- 'তুমি আমার প্রথম সকাল', 'হাসতে দেখ গাইতে দেখ', 'আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি', 'জেল থেকে বলছি', 'হাজার বর্ষা রাত', 'পলাশীর প্রান্তর', 'বিবাগী' 'কেউ সুখী নয়' 'প্রিয় আকাশী'। বর্তমানের জনপ্রিয় উপন্যাস- আসমান, দখল, দারবিশ, রাখাল, ফ্রন্টলাইন, ও অন্তিমের লেখক তিনি।ইংরেজি অনুবাদে ব্রিটিশ পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত তার নভেল The Seize এখন পাওয়া যাচ্ছে পৃথিবীর সমস্ত নাম করা বুক স্টোরে। পয়লা বৈশাখের এক কাকডাকা ভোরে জন্ম নিয়েই দেখেন- মুক্তিযুদ্ধ। তখন যুদ্ধ না বুঝলেও নব্বই দশকের স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনের ভেতর দিয়েই তাঁর বেড়ে ওঠা। ইন্টারমিডিয়েটে পড়াকালেই স্বৈরশাসকের জেল জুলুম আর হুলিয়া মাথায় নিয়ে চলে আসেন নাটোর থেকে ঢাকায় । অভিনয়ের উপর এক বছরের ডিপ্লোমা কোর্স শেষে গ্রুপথিয়েটার নাট্যচক্রের সঙ্গে মঞ্চনাটকে কাজ করতে করতেই ধীরে ধীরে বিকশিত হতে থাকেন শিল্পের অন্যান্য মাধ্যমে।অভিভাবকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে একদল গানপাগল তরুণ ব্যান্ড সংগীতের মাধ্যমে বাংলা গানের ধারায় যে-পরিবর্তন এনেছে, শিবলী তাদেরই অন্যতম। যুগযন্ত্রণার ক্ষ্যাপামো মজ্জাগত বলেই প্রথা ভাঙার যুদ্ধে শিবলী হয়ে ওঠেন আপাদমস্তক 'রক'। আধুনিক জীবনযন্ত্রণাগ্রস্ত তারুণ্যের ভাষাকে শিবলী উপস্থাপন করেছেন অত্যন্ত সহজসরল 'রক' এর ভাষায়। আর তাঁর সাফল্য এখানেই । তাই অল্প সময়ের মধ্যেই শিবলী পরিণত হয়েছেন এদেশের ব্যান্ড সংগীতজগতের কিংবদন্তি গীতিকবিতে । শিবলীর লেখা জনপ্রিয় গানের সংখ্যা প্রায় চার'শ। 'কমপ্লিট ম্যান' খ্যাত ঝুঁটিবাঁধা সেঞ্চুরি ফেব্রিকসের দুর্দান্ত সেই মডেল শিবলী ছিলেন নব্বই দশকের ফ্যাশন-আইকন। তিনি একজন সফল নাট্যকার। বিটিভির যুগে তাঁর লেখা প্রথম সাড়া জাগানো নাটক 'তোমার চোখে দেখি'(১৯৯৫)। আরও লিখেছেন- রাজকুমারী (১৯৯৭) সহ প্রচুর টিভি নাটক। নিজের লেখা নাটক 'রাজকুমারী'তে মির্জা গালিব চরিত্রে তাঁর অনবদ্য অভিনয় এখনও অনেকের মনে থাকার কথা।শিবলীর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলো- ইচ্ছে হলে ছুঁতে পারি তোমার অভিমান (১৯৯৫)। তুমি আমার কষ্টগুলো সবুজ করে দাও না(২০১০)। মাথার উপরে যে শূন্যতা তার নাম আকাশ, বুকের ভেতরে যে শূন্যতা তার নাম দীর্ঘশ্বাস'(২০১৪)। বাংলা একাডেমী প্রকাশ করেছে তাঁর 'বাংলাদেশে ব্যান্ড সংগীত আন্দোলন'(১৯৯৭), নামে ব্যান্ড সংগীতের ওপর লিখিত প্রথম এবং একমাত্র গবেষণাধর্মী প্রবন্ধগ্রন্থ।শিবলী'র কাহিনী সংলাপ চিত্রনাট্যে ও গীতিকবিতায় প্রথম পূর্ণদৈঘ্য চলচ্চিত্র 'পদ্ম পাতার জল'(২০১৫)। নিজের লেখা সুরে কণ্ঠে ও সঙ্গীত পরিচালনায় প্রথম অডিও এ্যালবাম-'নিয়ম ভাঙ্গার নিয়ম' ।শিবলী'র প্রথম এবং বেস্টসেলার উপন্যাস- দারবিশ (২০১৭)। স্বভাবজাত বোহেমিয়ান, ঘুরেছেন এশিয়া ইউরোপ আর আমেরিকা সহ পৃথিবীর পথে প্রান্তরে।। দুই সন্তান- ওমর এবং ওসমানের বাবা তিনি।