গল্প পড়া কিংবা শোনার মধ্যে এক অনাবিল আনন্দ। এ আনন্দ আমাদের শৈশব-কৈশোরকে করে সমৃদ্ধ। চিন্তা, কল্পনা ও সৃজনশীলতাকে করে শাণিত। বাংলা ভাষায় রচিত শিশু-কিশোর উপযোগী ছড়া গল্পের ভুবনে খান মুহম্মদ মঈনুদ্দীন একটি সুপরিচিত ও প্রিয় নাম। ‘ঐ দেখা যায় তাল গাছ, ঐ আমাদের গাঁ...’ ছড়াটি পাঠ করেনি এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া যাবে না। তিনি তার সৃজনশীলতা শুধু ছড়া-কবিতাতেই সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি শিশু-কিশোরদের জন্য লিখেছেন গল্প। খান মুহম্মদ মঈনুদ্দীনের গল্প মানে একটা রঙিন জগতের সন্ধান পাওয়া। ‘একটি রাজহাঁসের কাহিনী’ তেমনি একটি রঙিন ও আনন্দদানের গল্প। এ গল্পে একটি রাজহাঁস ও একটি মুরগির বন্ধুত্ব ও তাদের ঘটনার কথা রয়েছে। এখনো আমাদের গ্রামীণ জীবনে হাঁস-মুরগি-গরু-ছাগল-বিড়াল, নানা জাতের পাখি দেখতে পাওয়া যায়। শহরের শিশু-কিশোরেরা হয়তো এগুলো সহজে দেখতে না পেলেও গ্রামের মানুষেরা এগুলোর সাথেই বসবাস করে। এই গল্পে রাজহাঁস ও মুরগির বীরত্বের দৃশ্য চিত্রায়িত হয়েছে। বন্যার পানিতে চারিদিক জলে ডুবে গেছে। ফলে রাজহাঁস পানিতে ঘুরতে পারলেও মুরগি পানিবন্দি হয়ে পড়ে। পানিবন্দি একঘেয়েমি জীবন থেকে মুক্তি দিতে রাজহাঁস বন্ধু মুরগিকে পিঠে নিয়ে ঘুরতে বের হয়। তারা অনেকে দূরে একটি গাছ দেখতে পায়। সেই গাছে অনেক পাখি। কিন্তু পাখিদের মন ভালো নেই। তারা সব সময় আতঙ্ক ও ভয়ে থাকে। এর কারণ একটি দুষ্টু বিড়াল। এ কথা রাজহাঁস শোনার পরে মুরগিকে নিয়ে বিড়ালটিকে উচিত শিক্ষা দেয়। পাখিদের সবার মন ভালো হয়ে যায়। রঙিন ঝকঝকে আঁকা ছবির সাথে এ বইয়ের গল্পটি খুবই নান্দনিকভাবে সাজানো হয়েছে। গল্প পাঠের যে তৃপ্তি ও উত্তেজনা তা এ গল্পের মধ্যে রয়েছে ষোলো আনা। গল্পের ভাষা ও সহজবোধ্য শব্দের ব্যবহারের ফলে গল্পটি পড়তে শিশু-কিশোরদের অভিধান কিংবা অভিভাবকদের সাহায্য নিতে হবে না। মানুষ কিংবা পশুপাখিদের মধ্যে প্রকৃত বন্ধুত্ব হলে যেকোনো বিপদ কিংবা বাধা অতিক্রম করে জয়ী হওয়া যায়, এ গল্পটি পাঠে এ শিক্ষাই আমরা পাব। যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে পারলে সেখানে অন্যায়ের পতন ঘটবে―এটাই চিরসত্য। রূপক অর্থে ‘একটি রাজহাঁসের কাহিনী’ গল্পটি সেই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে।
খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন (৩০ অক্টোবর ১৯০১ – ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৮১) ছিলেন বাংলাদেশের খ্যাতিমান সাহিত্যিক। তিনি ১৯৫০ ও ৬০-এর দশকে শিশুতোষ সাহিত্য রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর লেখা ‘কানা বগির ছা’ ছড়াটি বাংলাদেশের শিশুদের নিকট অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং যুগস্রষ্টা নজরুল নামক জীবনীর জন্য তিনি বহুলভাবে সমাদৃত। তার লিখিত বইয়ের সংখ্যা ২০টির অধিক। এছাড়াও তিনি আল-হামরা লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠাতা, যা বর্তমানে আল-হামরা প্রকাশনী নামে পরিচিত। কর্মজীবনে তিনি কোলকাতা কর্পোরেশন স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। মঈনুদ্দীন ১৯৬০ সালে শিশু সাহিত্যে বাংলা একাডেমী পুরস্কার লাভ করেন। যুগস্রষ্টা নজরুল বইটির জন্য তিনি ১৯৬০ সালে ইউনেস্কো পুরস্কার লাভ করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭৮ সালে তিনি সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য একুশে পদক লাভ করেন।