আমাদের দেশে এককালে চার্বাক নামে একদল দার্শনিক ছিলেন। তারা মনে করতেন, কোনও একটা বিষয় বা ঘটনা সম্পর্কে একদম ঠিকঠাক জ্ঞান দিতে পারে কেবলমাত্র আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোই। যা চোখে দেখে বা চেখে দেখে যাচাই করা যায় অর্থাৎ যা কিনা বাস্তব-সত্য তাকেই তাঁরা স্বীকার করতেন এবং মানুষকে মিথ্যা বিশ্বাসের খোলস থেকে বেরিয়ে আসতে বলতেন। মোদ্দা কথা, আমাদের এই বিশাল বিশ্ববহ্মা-ে যা কিছু প্রত্যক্ষ করা যায়, সেগুলোর অস্তিত্বই তারা মানতে রাজি ছিলেন। কিন্তু “হাঁসজারু” ‘বকচ্ছপ’ কিংবা ‘টিয়ামুখো গিরগিটি’এগুলোর অস্তিত্ব তারা নিঃসন্দেহে মানতেন না। কেননা বাস্তব জগতে আমরা অনেক হাতড়ালেও এগুলোর হদিস পাব না। ঠিক যেমনটি এই দুনিয়ার কোথাও খুঁজে পাব না ভূত-প্রেত, জুজুবুড়ি কিংবা দেবতা-অপদেবতাদের। তাই চার্বাকরাও এইসব হাবিজাবি, গাঁজাখুরি বিষয়গুলোকে একটুও বিশ্বাস করতেন না। তোমাদের মধ্যে কেউ হয়তো এক্ষুণি ফস্ করে বলে বসবে ‘কেন আমার অমুকে যে তমুক দিন ভর সন্ধ্যায় পুকুরঘাটে যেতে গিয়ে ভূত দেখেছিলেন কিংবা ‘আমার অমুকের গুরুদেব যে পঞ্চমু-ির আসনে বসে তমুক দেবতাকে বাঁশি বাজাতে দেখেছিলেন’ ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন দ্যাখ, এমন তো হতেই পারে যে যিনি বা যাঁরা এই ঘটনাগুলোর কথা তোমাদের বলেছেন হয় তারা সঠিক কথা বলেন নি, নয়তো তাঁদের দেখা বা শোনার মধ্যেই কোথাও ঘাটতি থেকে গেছিল। যদি তাদের বক্তব্য সত্যিই হয়, তাহলেও এটা মানতেই হবে যে তোমাদের ওইসব পরিচিত জন যাঁরা ভূত-প্রেত-দেবতা দর্শনে ভীত বা প্রীত হয়েছেন, তারা অন্ধ বিশ্বাসের ফলে কমবেশি মনোবিকারের শিকার। কারণ, এই দুনিয়ায় ‘অলৌকিক’ বলে কিছু নেই। সবকিছুরই যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে ব্যাখ্যা মেলে। আসলে ভূত-প্রেত, দেব-দ্বিজে বিশ্বাস মানুষের অত্যন্ত প্রাচীন একটা বিশ্বাস। প্রাকৃতিক ও সামাজিক ঘটনাগুলো মানুষ যখন বিজ্ঞানের আলোয় বুঝে উঠতে পারে নি, তখনই তাদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল এ রকম নানা ভ্রান্ত ধ্যানধারণা ও কুসংস্কার। আত্মবিশ্বাসের অভাবে ও অজ্ঞানতার প্রভাবে মানুষ ছিল অলৌকিক বা দৈবীশক্তির ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। জলপড়া-তেলপড়া, মন্ত্রতন্ত্র, ওঝা-গুনিনের ঝাড়ফুঁক, তাবিজ- কবচ-মাদুলিতে মানুষ খুঁজে বেড়াত তার যাবতীয় রোগ বালাইয়ের প্রতিকার। শিশু যখন জন্মায় তখন তার মনের ঘরে ভূত-প্রেতের ভয় কিম্বা দেব-দেবীতে বিশ্বাস কোনও কিছুই বাসা বেঁধে থাকে না। পরে বড় হয়ে ওঠার সাথে সাথে আমাদের সমাজে সেই আদিকাল থেকে চলে আসা আজগুবি সব বিশ্বাস কাব্য-কাহিনি, গল্প-গাঁথা, নানা ঘটনা ও রটনার মাধ্যমে সহজেই শিশুমনের দখল করে নেয়। তৈরি করে এসব সম্পর্কে বদ্ধমূল ভ্রান্ত ধারণা। সময়ে-অসময়ে “বনের ভূত” নয় এইসব “মনের ভূত’ই আমাদের ভয় দেখায়।