বাংলা সাহিত্যে অন্যধারার লেখিকা শ্রীমতী মহাশ্বেতা দেবী। লেখিকা জীবনের শুরুতে এই বৈশিষ্ট্য ধরা না পড়লেও ক্রমেই তিনি খঁুজে পেলেন তাঁর আত্মবিশ্বাসের ভূমি। অন্তেবাসী মানুষ, গ্রামের গরিব আদিবাসী সম্প্রদায়, প্রান্তিক সমাজের লোকজন, তাঁর লেখনিতে যেন প্রাণ। যখন তিনি ছোটদের জন্য লেখেন তখনও সেই আলাদা ধারাটির ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তাহলে কি তিনি ওই ধারার লেখিকা। না, তিনি বিচিত্র ধরনের পাঠকের মনে বিচিত্র তৃপ্তি দিয়ে থাকেন। অন্তরঙ্গ ছবি যেমন ফুটে ওঠে তাঁর লেখায় আবার আধুনিক জীবনের জীবনকথা তাঁর নির্মাণে দেখা যায়। ন্যাদোশ একটি গরু। না, ন্যাদোশ একটি চরিত্র। সে খটখটিয়ে একেবারে দোতলায় উঠত কিন্তু সে গাছে উঠে না। তাঁর দলের লোকদের পরামর্শে এই ন্যাদোশকে মা ছোট চাপরাশির নিকট থেকে ক্রয় করেছিলেন। দুধের সমস্যা ছিল বাড়িতে। কিন্তু দেখা গেল ছোট চাপরাশিকে দেওয়া গাইবরণের নতুন ধুতির অর্ধেক ছিঁড়েবাকি অর্ধেক সে খেয়ে ফেলেছে। এরপর তালিকায় যুক্ত হলো খাতা—পুস্তক। ন্যাদোশ সর্বভুক নয়, কত ধরনের কান্ড ঘটলো সে নাদোশকে নিয়ে! ন্যাদোশ কি শুধু? টাটকা জীবনের গল্প থেকে ভূত কি রূপকথার গল্পেও লেখিকার জুড়ি মেলা ভার। যেমন খুদে ডাকাত। খুদে তো আর ছোট ছেলে নয় ডাকাত নয়। সে ছিল কোয়ালি। কারো গরুর অসুখ হলে চিকিৎসা করতো, ওষুধ দিতো, মন্তর পড়ত, আর ঝাঁড়ফুকও করতো। এর পরে গোয়ালিয়া গাইত। গোয়ালিয়া গেয়ে চাল—ডাল পয়সা যা পেত সেগুলো গরিব গেরস্থকে দিয়ে তার ঘরে খেয়ে নিজের মাচাঙ্গে উঠেযেতো। পরের আবার আগের গেরস্থর ঘরে। একবার ঘূর্ণিঝড়ে দেশ ডুবল, ফসল সব নষ্ট হলো। শুরু হলো দেশ জোড়া মন্বন্তর, সাথে ডাকাতি। ডাকাত কেউ ধরতে পারে না। এমন মৈজুদ্দিন দারোগাও পারে না। পরিশেষে কি ডাকাত ধরা পড়েছিল? রহরমপুরে আরমানি গির্জার উঠোনে এক চাঁপার গাছ ছিল। সাদা ফুলে গাছ ভরে যেতো সাথে কি যে সুগন্ধ। এই চাঁপা গাছের নিচে এসে একদিন আশ্রয় নিলো বুড়োপাড়ার মাতো তার প্রিয় ছাগলছানা অজুর্নকে বুকে করে। তাদের গাঁয়ে অনেক হেনস্তা হয়েছে। দোষ ছিলো অজুর্ন মানি কাপালিকের পিঠে গুতো মেরেছে। অমনি কাপলিক বলে উঠল— ওকে এখুনি বলি দিতে হবে। কাপালিক আর গাঁয়ের লোকদের খর দৃষ্টি আড়াল করে অজুর্নকে নিয়ে নিশ্চিত মাতো আশ্রয়ে পৌঁছে গেল। মহাশ্বেতা দেবীর এমনি অনেক গল্প—উপন্যাস—কাহিনি—জীবনীর সমাহার নিয়ে প্রকাশিত হলো ‘কিশোর মহাশ্বেতা অমনিবাস’।
১৪ জানুয়ারি, ১৯২৬ সালে ব্রিটিশ ভারতের ঢাকা শহরে মহাশ্বেতা দেবী জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন একজন ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক ও মানবাধিকার আন্দোলনকর্মী।তাঁর বাবা মণীষ ঘটক ছিলেন কল্লোল সাহিত্য আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত খ্যাতনামা কবি ও ঔপন্যাসিক। তিনি ‘যুবনাশ্ব’ ছদ্মনামে লিখতেন। মণীষ ঘটকের ভাই ছিলেন বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটক। মহাশ্বেতা দেবীর মা ধরিত্রী দেবীও ছিলেন লেখক ও সমাজকর্মী। তাঁর ভাইয়েরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে খ্যাতিমান ছিলেন। যেমন, শঙ্খ চৌধুরী ছিলেন বিশিষ্ট ভাস্কর এবং শচীন চৌধুরী ছিলেন দি ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি অফ ইন্ডিয়া পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক। মহাশ্বেতা দেবীর বিদ্যালয়-শিক্ষা শুরু হয়েছিল ঢাকা শহরেই। ভারত বিভাজনের পর তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন। এরপর তিনি শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠভবনে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্য বিভাগে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাগুলি হল হাজার চুরাশির মা, রুদালি, মার্ডারারের মা, বেহুলার বারোমাস্যা, দিয়া ও মেয়ে নামতা, স্বপ্ন দেখার অধিকার, প্রস্থানপর্ব, ব্যাধখণ্ড, অরণ্যের অধিকার ইত্যাদি। মহাশ্বেতা দেবী ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তীসগঢ় রাজ্যের আদিবাসী উপজাতিগুলির (বিশেষত লোধা ও শবর উপজাতি) অধিকার ও ক্ষমতায়নের জন্য কাজ করেছিলেন। তিনি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার (বাংলায়), জ্ঞানপীঠ পুরস্কার ও র্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার সহ একাধিক সাহিত্য পুরস্কার এবং ভারতের চতুর্থ ও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান যথাক্রমে পদ্মশ্রী ও পদ্মবিভূষণ লাভ করেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান বঙ্গবিভূষণে ভূষিত করেছিল। তিনি ২৮ জুলাই, ২০১৬ মৃত্যুবরণ করেন।