উত্তর আফ্রিকা বলতে সাধারণত লিবিয়া, তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া, মরক্কো ও মৌরিতানিয়াকে বোঝানো হয়ে থাকে। ইসলামপূর্ব সময়ে এই জনপদে বার্বার, ফিনিশীয়, কার্টেজিনা, রোমান, গ্রিক ও ভান্দালদের মতো বিভিন্ন জাতির বসবাস ছিল। অগ্নিপূজা, ইয়াহুদি ও খ্রিষ্টধর্মের চর্চা হতো সেখানে। কালক্রমে খ্রিষ্টধর্ম উত্তর আফ্রিকায় তাদের অবস্থান করে নেয়; কিন্তু সময়ের আবর্তে ক্যাথলিক ও অর্থোডক্সের মধ্যে দেখা দেয় তীব্র মতভেদ ও বিভেদ। বিভেদ ও সংঘাত তাদের রাষ্ট্রকাঠামোর মূলে আঘাত হানে। বিশৃঙ্খলা ও হানাহানিতে তারা স্বভাবজাতভাবে নতুন কোনো বিকল্প খুঁজতে থাকে। এহেন মুহূর্তে উমর রা.-এর নির্দেশে ইসলামের শাশ্বত বাণী নিয়ে লিবিয়ার বারকায় উপস্থিত হন মহান সাহাবি আমর ইবনুল আস রা.। একের পর এক অভিযানে আবদুল্লাহ ইবনু সাআদ ইবনু আবিস সারহ, মুআবিয়া ইবনু হুদাইজ, উকবা ইবনু নাফি, আবুল মুহাজির, জুহাইর ইবনু কায়েস, হাসসান ইবনু নুমান ও মুসা ইবনু নুসাইর আল লাখমির মতো মহান মানুষেরা নেতৃত্ব দেন। উত্তর আফ্রিকায় মুজাহিদ ও দায়িদের সোনালি ছোঁয়ায় গড়ে ওঠা কায়রাওয়ান শহর এবং বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনবদ্য সব ঘটনা গ্রন্থটিতে তুলে ধরেন প্রখ্যাত ইতিহাসগবেষক ড. শায়খ আলি মুহাম্মাদ সাল্লাবি। লিবিয়ার বাসিন্দা হিসেবে লেখক ইসলামপূর্ব সময় এবং তৎকালীন ধর্ম ও জাতি সম্পর্কে বিশদ বিবরণের পাশাপাশি গ্রন্থটিকে সাহাবি ও তাবিয়িদের ইমানদীপ্ত দাস্তান দিয়ে সাজিয়েছেন।
ফকিহ, রাজনীতিক ও বিশ্বখ্যাত ইতিহাসগবেষক। ইসলামের ইতিহাসের উপর বিশ্লেষণধর্মী তাত্ত্বিক গ্রন্থ রচনা করে দুনিয়াজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন। এই মহা মনীষী ১৯৬৩ সনে লিবিয়ার বেনগাজি শহরে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পড়াশোনা বেনগাজিতেই করেন। যৌবনের প্রারম্ভেই গাদ্দাফির প্রহসনের শিকার হয়ে শায়খ সাল্লাবি আট বছর বন্দি থাকেন। মুক্তি পাওয়ার পর উচ্চ শিক্ষার জন্য তিনি সাউদি আরব চলে যান। মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের দাওয়া ও উসুলুদ্দিন বিভাগ থেকে ১৯৯৩ সনে অনার্স সম্পন্ন করেন। তারপর চলে যান সুদানের উম্মু দুরমান বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে উসুলুদ্দিন অনুষদের তাফসির ও উলুমুল কুরআন বিভাগ থেকে ১৯৯৬ সনে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। সেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ১৯৯৯ সনে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল ‘ফিকহুত তামকিন ফিল কুরআনিল কারিম’। ড. আলি সাল্লাবির রাজনৈতিক দীক্ষাগুরু বিশ্বখ্যাত ফকিহ ও রাজনীতিক ড. ইউসুফ আল কারজাবি। কারজাবির সান্নিধ্য অর্জনে তিনি ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে কাতার গমন করেন। নতুন ধারায় সিরাত ও ইসলামি ইতিহাসের তাত্ত্বিক গ্রন্থ রচনা করে ড. আলি সাল্লাবি অনুসন্ধিৎসু পাঠকের আস্থা ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। নবিজির পুর্ণাঙ্গ সিরাত, খুলাফায়ে রাশিদিনের জীবনী, উমাইয়া খিলাফত, আব্বাসি খিলাফত, উসমানি খিলাফতের উত্থান-পতনসহ ইসলামি ইতিহাসের সাড়ে তেরোশ বছরের ইতিহাস তিনি রচনা করেছেন। তা ছাড়া ইসলামি ইতিহাসে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করা ব্যক্তিদের নিয়ে তিনি আলাদা আলাদা গ্রন্থ রচনা করেছেন। ড. আলি মুহাম্মাদ সাল্লাবির রচনা শুধু ইতিহাসের গতানুগতিক ধারাবর্ণনা নয়; তাঁর রচনায় রয়েছে বিশুদ্ধতার প্রামাণিক গ্রহণযোগ্যতা, জটিল-কঠিন বিষয়ের সাবলীল উপস্থাপনা ও ইতিহাসের আঁকবাঁকের সঙ্গে সমকালীন অবস্থার তুলনীয় শিক্ষা। এই মহা মনীষী সিরাত, ইতিহাস, ফিকহ ও উলুমুল কুরআনের উপর আশির অধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর রচনাবলি ইংরেজি, তুর্কি, ফরাসি, উর্দু ও বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়ে পৃথিবীর জ্ঞানগবেষকদের হাতে হাতে পৌঁছে যাচ্ছে। আল্লাহ তাঁকে দীর্ঘ, নিরাপদ ও সুস্থ জীবন দান করুন। আমিন। —সালমান মোহাম্মদ লেখক, অনুবাদক ও সম্পাদক ২৪ মার্চ ২০২০