ডুবে যাবার সুখে আমার ঘটের মতো যেন অঙ্গ উঠে ভরে । ভেসে গেলেম আপন মনে, ভেসে গেলেম পারে, ফিরে এলেম ভেসে, সাঁতার দিয়ে চলে গেলেম, চলে এলেম যেন সকল-হারা বেশে। (দিঘি) ‘বালিকা-বধূ' কবিতায় কবি তাঁহার বিরাট, মহান স্বামীর সহিত বালিকা-বধূর সমস্ত বুদ্ধিহীনতা ও সরলতা লইয়া মিলিত হইতে চাহিতেছেন ৷ ‘বালিকা-বধূ' কবিতাটি রবীন্দ্রনাথের সমস্ত মিস্টিক কবিতার মধ্যে একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কবিতা । ভগবানকে স্বামী- রূপে কল্পনা করা নূতন নয়। বৈষ্ণব-সাহিত্যে, সুফী সম্প্রদায় ও অন্যান্য মিস্টিকদের সাহিত্যে ভগবানকে স্বামীরূপে, প্রিয়তমরূপে কল্পনা করা হইয়াছে। বৈষ্ণব সাধকেরা অনুভব করেন, একমাত্র সেই অখিলরসামৃতমূর্তি শ্রীকৃষ্ণই পুরুষ, আর জীবমাত্রেই তাঁহার প্রণয়িনী । পুরুষ কেবল সেই পুরুষোত্তম, আর জীবমাত্রেই নারী। সেই কল্পনায় পূর্ণ মাধুর্য- রসের অবতারণা করা হইয়াছে। প্রেমিক-প্রেমিকার পরস্পরের পূর্ণ আত্মদান ও ভয়- সম্ভ্রমহীন প্রণয়-লীলাই উহার মূল । কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কল্পনায় প্রিয়তমের ঐশ্বর্যময় মূর্তিই বেশি ফুটিয়া উঠিয়াছে, এবং বাঙালী ঘরের বালিকা-বধূর মনস্তত্ত্বের ভিত্তিকে অবলম্বন করিয়া উহার যে প্রকাশ হইয়াছে, তাহার বাস্তবিকই মনোহর । বুদ্ধিহীনা বালিকা-বধূ তাহার স্বামী যে কতো বড়, তাহার কতো মহিমা, কতো শক্তি, কতো মাধুর্য, তাহা বোঝে না । কেবল বোঝে যে, সে তাহার স্বামী। একটা সংস্কারগত মমত্ববোধ স্বামীর উপর তাহার অধিকার দিয়াছে বটে, কিন্তু সে অধিকারের স্বরূপ সে বোঝে না। শিশু-সুলভ বুদ্ধিতে মনে করে, সে বুঝি তাহার খেলার সাথী মাত্র। কিন্তু স্বামী বুঝিতে পারেন যে, বালিকা-বধূর এ অবস্থা চিরদিন থাকিবে না, পূর্ণ যৌবনে সে স্বামীকে চিনিতে পারিবে । প্রণয়-লীলায় সে একদিন তাহার নিজের অধিকারে প্রতিষ্ঠিত হইবে এবং স্বামীর গভীর প্রেম আকর্ষণ করিতে পারিবে । কবি তাঁহার বরের কাছে আজ বালিকা-বধূ আছেন, কিন্তু পরে তিনি যুবতী প্রণয়িনী হইবেন । তাঁহার বর তাহা জানেন, তুমি বুঝিয়াছ মনে একদিন এর খেলা ঘুচে যাবে ওই তব শ্রীচরণে । সাজিয়া যতনে তোমারি লাগিয়া বাতায়ন তলে রহিবে জাগিয়া, শতযুগ করি মানিবে তখন ক্ষণেক অদর্শনে, তুমি বুঝিয়াছ মনে । আজ হৃদয়-রাজার সঙ্গে মিলনে কবির প্রাণ পরিতৃপ্ত। এই মিলনে তিনি এক অমূল্য সম্পদ লাভ করিয়াছেন । তাঁহার চোখে আনন্দের অঞ্জন লাগিয়াছে— যে দিকে তাকাইতেছেন, সবই মধুময় । প্রভাতের অপর্যাপ্ত আলো যেন তাঁহার হৃদয়ে প্রবেশ করিয়াছে । আজ তিনি গভীর-আনন্দিত, পরমপরিতৃপ্ত —
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার, চিত্রশিল্পী, সংগীতস্রষ্টা, অভিনেতা, কন্ঠশিল্পী, কবি, সমাজ-সংস্কারক এবং দার্শনিক। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য প্রথম বাঙালি হিসেবে ১৯১৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ মে তৎকালীন ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে কলকাতার ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিমনা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। ভানুসিংহ ঠাকুর ছিল তাঁর ছদ্মনাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই মানেই এক মোহের মাঝে আটকে যাওয়া, যে মোহ পাঠককে জীবনের নানা রঙের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয় নানা ঢঙে, নানা ছন্দে, নানা সুর ও বর্ণে। তাঁর ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাট্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর কিছুদিন পরই আলোর মুখ দেখে। কাবুলিওয়ালা, হৈমন্তী, পোস্টমাস্টারসহ মোট ৯৫টি গল্প স্থান পেয়েছে তাঁর ‘গল্পগুচ্ছ’ গ্রন্থে। অন্যদিকে ‘গীতবিতান’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে ১,৯১৫টি গান। উপন্যাস, কবিতা, সঙ্গীত, ছোটগল্প, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনীসহ সাহিত্যের সকল শাখাই যেন ধারণ করে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমূহ। তিনি একাধারে নাট্যকার ও নাট্যাভিনেতা দুই-ই ছিলেন। কোনো প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া তিনি চিত্রাংকনও করতেন। তৎকালীন সমাজ-সংস্কারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এই গুণী ব্যক্তিত্ব। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাতেই অনূদিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমগ্র। তাঁর যাবতীয় রচনা ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ নামে ত্রিশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর এতদিন পেরিয়ে গেলেও তাঁর সাহিত্যকর্ম আজও স্বমহিমায় ভাস্বর। আজও আমাদের বাঙালি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে বিশ্বকবির সাহিত্যকর্ম।