নাট্যরীতি বলতে আসলে কোন্ রীতিতে নাটকটি রচিত, নাটকটির গঠন-কাঠামো পরিলক্ষিত, তার মঞ্চ-পরিস্থিতি, চরিত্র-চিত্রণ, সংলাপ, দ্বন্দ্ব সৃষ্টিসহ সমকালীন দর্শক রুচি ও যুগ-প্রভাবও সম্পর্কিত। বাংলা নাটকের ১৮০০-১৮৫০ যদি প্রহসন যুগ ধরি; সে প্রহসনের আঙ্গিক কৌশলে শৈথিল্য এবং ১৮৫০-১৯২০ পর্যন্ত যদি ধরি সামাজিক ও ঐতিহাসিক নাটক পর্যায়—তবে এ সময়ের মঞ্চরীতি সামাজিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতের সাথে সম্পর্কিত। ১৯২০-৪৭ মুসলিম নাট্যকারদের ঐতিহাসিক স্বদেশপ্রেমধর্মী নাটক। ১৯৪৭-৭০ সময় পর্বে ওয়ালীউল্লাহর নাটক পড়ে। ১৯৫৫তে ‘বহিপীর’ লিখেন। প্রকাশিত হয় ১৯৬০ এ। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ তাঁর 'তরঙ্গভঙ্গ' নাটকে Exprssionistic নাট্য চিন্তা এবং ‘উজানে মৃত্যু’তে Absurdity ও Exprssionistic চেতনা ও ‘বহিপীর’ এ Exestentialistic নাট্যচিন্তার পরিচয় দিয়ে কালা নাট্য রীতিতে অভিজ্ঞত্মের পরিচয় দিয়েছেন। ১৮০০-১৮৫০ সময় পর্বের বাংলা প্রহসনের মধ্যে সমাজকে সংস্কারের ব্যাপার ছিলো এবং ধনী-জমিদারদের আনন্দ-যাপনের একটি ব্যাপারও ছিলো । তাই সে প্রহসন-গঠন-কৌশল ও মঞ্চরীতিতে একটি সহাস্য পরিবেশ নির্মাণের ব্যাপার ছিলো। ১৮৫০-১৯২০ সময় পর্বে মধুসূদন, দীনবন্ধুমিত্র, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, মীর মশাররফ হোসেন, ডি. এল. রায়, রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাব। মধুসূদন তাঁর ‘কৃষ্ণকুমারী’তে Shakespeareen Tragedy চিন্তার পরিচয় দিয়ে বাংলা নাট্যরীতির উন্নয়ন করেন। গিরিশচন্দ্র ঘোষের সামাজিক নাটক ‘প্ৰফুল্লে’ তিনি সামাজিক ও পারিবারিক চিন্তনের ও নাট্য চরিত্রের মধ্যে ষড়যন্ত্র-প্রসঙ্গ এনে মধ্যবিত্ত মানসের নাট্যচিন্তায় বৈচিত্র্য আনতে চেয়ে বাংলা নাট্যরীতিকে ঋদ্ধ করেন। মীর মশাররফ হোসেন ও দীন বন্ধুমিত্র যথাক্রমে তাঁদের ‘জমিদার দর্পণ' ও ‘নীলদর্পণ' নাটকে সাধারণ প্রজাদের ওপর জমিদারদের অত্যাচার এবং ‘নীলদর্পণে’ নীলকর ইংরেজরা চাষীদের ওপর যে অত্যাচার করেছে—চরিত্র সৃষ্টির নৈপুন্যে ও সংলাপ সৃষ্টির নৈপুন্যে ও সমাজ সচেতনতার পরিচয় দিয়ে বাংলা নাট্যরীতিকে সমৃদ্ধ করেন।
Syed Waliullah (তাঁর জন্ম চট্টগ্রাম শহরের ষোলশহর এলাকায়, ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট) তাঁর পিতা সৈয়দ আহমাদুল্লাহ ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা; মা নাসিম আরা খাতুনও সমতুল্য উচ্চশিক্ষিত ও রুচিশীল পরিবার থেকে এসেছিলেন, সম্ভবত অধিক বনেদি বংশের নারী ছিলেন তিনি। ওয়ালীউল্লাহর আট বছর বয়সের সময় তার মাতৃবিয়োগ ঘটে। দুই বছর পর তার বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন টাঙ্গাইলের করটিয়ায়। বিমাতা এবং বৈমাত্রেয় দুই ভাই ও তিন বোনের সঙ্গে ওয়ালীউল্লাহর সম্পর্ক কখনোই অবনতি হয় নি। তার তেইশ বছর বয়সকালে কোলকাতায় চিকিৎসা করতে গিয়ে মারা যান। তার পিতৃমাতৃবংশ অনেক শিক্ষিত ছিলেন। বাবা এম এ পাশ করে সরাসরি ডেপুটি মেজিস্ট্রেট চাকুরিতে ঢুকে যান; মাতামহ ছিলেন কোলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স থেকে পাশ করা আইনের স্নাতক; বড়ো মামা এমএবিএল পাশ করে কর্মজীবনে কৃতি হয়ে খানবাহাদুর উপাধি পেয়েছিলেন এবং স্ত্রী ওয়ালীউল্লাহর বড়ো মামী ছিলেন নওয়াব আবদুল লতিফ পরিবারের মেয়ে, উর্দু ভাষার লেখিকা ও রবীন্দ্রনাথের গল্প নাটকের উর্দু অনুবাদক। ১৯৩৯ সালে তিনি কুড়িগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয় হতে ম্যাট্রিক, এবং ১৯৪১ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। তার আনুষ্ঠানিক ডিগ্রি ছিলো ডিস্টিঙ্কশনসহ বিএ এবং অর্থনীতি নিয়ে এমএ ক্লাশে ভর্তি হয়েও শেষে পরিত্যাগ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ওয়ালীউল্লাহ ঢাকায় এসে প্রথমে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের সহকারী বার্তা-সম্পাদক ও পরে করাচি কেন্দ্রের বার্তা-সম্পাদক (১৯৫০-৫১) হন। ১৯৫১-৬০ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান সরকারের পক্ষে নয়াদিল্লি, সিডনি, জাকার্তা ও লন্ডনে বিভিন্ন উচ্চ পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬০-১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি প্যারিসে পাকিস্তান দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি এবং ১৯৬৭-৭১ সাল পর্যন্ত ইউনেস্কোর প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট ছিলেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ দুটি গল্পগ্রন্থ নয়নচারা (১৯৫১), দুই তীর ও অন্যান্য গল্প এবং তিনটি নাটক বহিপীর (১৯৬০), তরঙ্গভঙ্গ (১৯৬৪) ও সুড়ঙ্গ (১৯৬৪) রচনা করেছেন। ছোটগল্প ও নাটকেও তিনি সমাজের কুসংস্কার, ধর্মীয় ভন্ডামি, মানসিক ও চারিত্রিক স্খলন ইত্যাদিকে প্রতিভাসিত করেছেন। তিনি দেশ-বিদেশের নানা সাহিত্য পুরস্কার এবং বাংলাদেশ সরকারের ‘একুশে পদক’ (মরণোত্তর, ১৯৮৩) লাভ করেন। ১৯৭১ সালের ১০ অক্টোবর প্যারিসে তাঁর মৃত্যু হয় এবং প্যারিসের উপকণ্ঠে মদোঁ-স্যুর বেল্ভু-তে তিনি সমাহিত হন।