রবীন্দ্রনাথের 'কল্পনা' কাব্যগ্রন্থের মধ্যে কবি তাঁর কাব্যাত্মার সংকটকে উত্তরিত করে বিশ্বদেবতার উপস্থিতির প্রতি তাঁর কাব্যিক-অভিনিবিষ্টতাসহ কবির কাব্যোত্তরণের দূরগামিতা লক্ষযোগ্য হয়ে ওঠেছে। ‘কল্পনা' কাব্যগ্রন্থের 'দুঃসময়' (১৩০৪) কবিতার মধ্যে কবি তাঁর কাব্য-অস্তিত্বের চেতনার দুঃসময়ের কথা বিবৃত করেছেন। কবির উচ্চারণ প্রণিধানযোগ্য : এ নহে মুখর বনমর্মরগুঞ্জিত, এ যে অজাগর-গরজে-সাগর ফুলিছে। এ নহে কুঞ্জ কুন্দকুসুমরঞ্জিত ফেনহিল্লোলে কলকল্লোলে দুলিছে। কোথা রে সে তীর ফুল পল্লবপুঞ্জিত, কোথা রে সে নীড়, কোথা আশ্রয়শাখা (দুঃসময়) বনের মর্মরের কথা কবি এখানে ব্যক্ত করেন নি; বরং কবির কাব্যিক অস্তিত্বের ‘আশ্রয়শাখা’ কবি এখানে প্রার্থনা করেছেন। কবি এ কবিতায় অধীর মরণ উছলে ওঠার কথা বলেছেন; নিবিড়-তিমির-আঁকা আশাহীন ভবিষত্যের দিকে তাকিয়ে কবি তাঁর কাব্যসত্তার গভীরতর উত্তরণের কথা এ কবিতায় ব্যক্ত করেছেন । পৃথিবীর যে কোন শিল্পী- সাহিত্যিকেরই তাঁদের সৃজনপর্বের যে কোন ক্ষণে তাঁদের সৃষ্টিসত্তার সংকট সৃষ্টি হতে পারে; অথচ গভীর জীবনবোধের প্রাণবন্ততা দিয়ে এবং প্রজ্ঞার সৃষ্টিশীল উচ্চতা দিয়ে তাঁরা সে দুঃসময়কে অতিক্রম করে নতুনতর সৃষ্টি ভুবন সৃষ্টি করে চলেন। “কল্পনা’ কাব্যগ্রন্থের ‘বর্ষামঙ্গল’ (১৩০৪) কবিতায় কবি বর্ষা ঋতুর বর্ষণমুখরতার অবিরল ধারাপ্রবাহের কথা ব্যক্ত করার সঙ্গে সঙ্গে জনপদবধূর রিরংসাপূর্ণ রোমাঞ্চবিলাসের অনুভূতি অভিব্যক্ত করেছেন; সাথে সাথে রয়েছে কবিপ্রিয়ার প্রতি কবির অনবদ্য মন নিবেদনের অভিনিবিষ্টতা । কবি যে লিখেছেন : “কুসুমপরাগ ঝরিবে ঝলকে ঝলকে, অধরে অধরে মিলন অলকে অলকে- কোথা পুলকের তুলনা। "(বর্ষামঙ্গল)
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার, চিত্রশিল্পী, সংগীতস্রষ্টা, অভিনেতা, কন্ঠশিল্পী, কবি, সমাজ-সংস্কারক এবং দার্শনিক। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য প্রথম বাঙালি হিসেবে ১৯১৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ মে তৎকালীন ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে কলকাতার ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিমনা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। ভানুসিংহ ঠাকুর ছিল তাঁর ছদ্মনাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই মানেই এক মোহের মাঝে আটকে যাওয়া, যে মোহ পাঠককে জীবনের নানা রঙের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয় নানা ঢঙে, নানা ছন্দে, নানা সুর ও বর্ণে। তাঁর ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাট্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর কিছুদিন পরই আলোর মুখ দেখে। কাবুলিওয়ালা, হৈমন্তী, পোস্টমাস্টারসহ মোট ৯৫টি গল্প স্থান পেয়েছে তাঁর ‘গল্পগুচ্ছ’ গ্রন্থে। অন্যদিকে ‘গীতবিতান’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে ১,৯১৫টি গান। উপন্যাস, কবিতা, সঙ্গীত, ছোটগল্প, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনীসহ সাহিত্যের সকল শাখাই যেন ধারণ করে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমূহ। তিনি একাধারে নাট্যকার ও নাট্যাভিনেতা দুই-ই ছিলেন। কোনো প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া তিনি চিত্রাংকনও করতেন। তৎকালীন সমাজ-সংস্কারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এই গুণী ব্যক্তিত্ব। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাতেই অনূদিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমগ্র। তাঁর যাবতীয় রচনা ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ নামে ত্রিশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর এতদিন পেরিয়ে গেলেও তাঁর সাহিত্যকর্ম আজও স্বমহিমায় ভাস্বর। আজও আমাদের বাঙালি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে বিশ্বকবির সাহিত্যকর্ম।