রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) অধ্যাত্মমুখীন কাব্যচিন্তার প্রভাব থেকেই তাঁর দ্বিতীয় অর্থাৎ শান্তিনিকেতন পর্বের নাটক রচনার সূত্রপাত। এই পর্বের নাটকে ‘ব্যক্তি আমি’ বিশ্বমানবে পরিণত। ব্যক্তির সীমা অতিক্রম করে রবীন্দ্রনাট্য চেতনা তখন ব্যক্তির বৃহত্তর জীবনে প্রতিস্থাপিত। আর এই অতীন্দ্রিয় অধ্যাত্ম ভাবকে পরিবেশন করার জন্য তিনি সংগীতের অনুগামী হয়েছেন। তাই এ পর্বের নাটকের মধ্যে গানের প্রতিফলন অনেক বেশি। রূপক সংকেতের দ্বারা সেই অধ্যাত্মলোকের তত্ত্বকে মানবজীবনের মধ্যে দিয়ে রূপায়িত করে দেখানোর জন্যই এই সংগীতের প্রয়োগ । নাটকে যে কথা ‘ব্যক্তি আমি' ‘বৃহত্তর মানবগোষ্ঠী' বলতে পারেনা, তা অনায়াসে বলে দেয় সংগীত। সেক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের তত্ত্বমূলক নাটকে সংগীতের প্রয়োগ তাৎপর্যপূর্ণ। “অচলায়তন” নাটক রচিত হয় ১৩১৮ সালের আষাঢ় মাসে; ছয় বৎসর পর ১৩২৪ সালের ফাল্গুন মাসে এই নাটকের একটি সংক্ষিপ্ত অভিনয়োপযোগী সংস্করণ প্রকাশিত হয়, তাহার নাম “গুরু”। * এই নাটকটিতে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষপাদের এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম দুই দশকের বাংলাদেশের উদার পাশ্চাত্য ভাবধারায় পুষ্ট শিক্ষিত স্বাধীনতাকামী মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের সমাজমানসের রূপ রূপকের আশ্রয়ে অতি সুস্পষ্টরূপে প্রকাশ পাইয়াছে। ভারতবর্ষের তথা বাংলাদেশের সমগ্র ইতিহাসের এইরূপ সুস্পষ্ট সজ্ঞান বোধের পরিচয় বঙ্কিমচন্দ্রে ছাড়া বাংলা সাহিত্যে আর খুব বেশি ইতিপূর্বে দেখা যায় নাই। আমাদের দেশে শতাব্দীর সঞ্চিত স্তূপীকৃত শাস্ত্রপুঁথি, আচার নিয়মের
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার, চিত্রশিল্পী, সংগীতস্রষ্টা, অভিনেতা, কন্ঠশিল্পী, কবি, সমাজ-সংস্কারক এবং দার্শনিক। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য প্রথম বাঙালি হিসেবে ১৯১৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ মে তৎকালীন ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে কলকাতার ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিমনা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। ভানুসিংহ ঠাকুর ছিল তাঁর ছদ্মনাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই মানেই এক মোহের মাঝে আটকে যাওয়া, যে মোহ পাঠককে জীবনের নানা রঙের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয় নানা ঢঙে, নানা ছন্দে, নানা সুর ও বর্ণে। তাঁর ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাট্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর কিছুদিন পরই আলোর মুখ দেখে। কাবুলিওয়ালা, হৈমন্তী, পোস্টমাস্টারসহ মোট ৯৫টি গল্প স্থান পেয়েছে তাঁর ‘গল্পগুচ্ছ’ গ্রন্থে। অন্যদিকে ‘গীতবিতান’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে ১,৯১৫টি গান। উপন্যাস, কবিতা, সঙ্গীত, ছোটগল্প, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনীসহ সাহিত্যের সকল শাখাই যেন ধারণ করে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমূহ। তিনি একাধারে নাট্যকার ও নাট্যাভিনেতা দুই-ই ছিলেন। কোনো প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া তিনি চিত্রাংকনও করতেন। তৎকালীন সমাজ-সংস্কারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এই গুণী ব্যক্তিত্ব। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাতেই অনূদিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমগ্র। তাঁর যাবতীয় রচনা ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ নামে ত্রিশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর এতদিন পেরিয়ে গেলেও তাঁর সাহিত্যকর্ম আজও স্বমহিমায় ভাস্বর। আজও আমাদের বাঙালি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে বিশ্বকবির সাহিত্যকর্ম।