জীবনানন্দ দাশকে (১৮৯৯-১৯৫৪) আধুনিক পঞ্চ-প্রধান কবির মধ্যে সর্বোচ্চ শ্রেষ্ঠ বলে আমি বিবেচনা করি। জীবনানন্দের কবিত্ব চেতনার সূক্ষ্ম নান্দনিকতা তাঁকে প্রকৃত ও শুদ্ধতাস্নাত কবি করেছে। অভিজ্ঞতা ও নিসর্গের বিস্তার তাঁর কবিতায় খুব সৌন্দর্য-দ্যোতক হিসেবে উপস্থাপিত। সময়, সমাজ, ইতিহাস, অর্থনীতি, রাজনীতি, দর্শন, ধর্ম, সংস্কৃতি ও নৈতিকতাচেতনা তাঁর কবিতাকে সুন্দরতায় ও জীবনময়তায় ভাস্বর করেছে। জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা (কলকাতা, নাভানা, ১৯৫৪) গ্রন্থ অবলম্বনে আমি এ প্রবন্ধে তাঁর কবিতার মূল্যায়ন করেছি। জীবনানন্দ দাশের (১৮৯৯-১৯৫৪) ঝরা পালক (১৯২৮) কাব্যের ‘নীলিমা' কবিতায় কবির ‘অতন্দ্র দূর কল্পলোক!' এ যে জীবনচিত্র ভেসে উঠেছে-তা ১৯২০ এর দশকের প্রথম বিশ্ব-যুদ্ধোত্তর জীবন বাস্তবতার রক্তাক্ততার সাক্ষ্য বহনকারী। জীবন-জটিলতা ও দুঃসহতায় মানুষের জীবন তখন পর্যুদস্ত। নগরীকে কবি বলেছেন : ‘নিঃসহায়' এবং নগরীর কারাগার-প্রাচীরের পারে ঊষার আকাশ ও মধ্যনিশীথের নীল প্রতিবিম্বিত হয়। শহরের কঙ্করগুলোও মরুভূমির তপ্তশ্বাসে মথিত এবং ‘অগণন যাত্রিকের প্রাণ’ সেখানে পথের সন্ধান পায় না। কারণ জনজীবনে জড়িয়ে রয়েছে অপশাসনের অর্থাৎ দুঃশাসনের কঠিন শৃঙ্খল। বাস্তবের রক্ততটে জীবনের এ খেলা বড়ো মর্মান্তিক। শহর হলো ‘লক্ষ কোটি মুমূর্ষু’র কারাগার । শিকারী ক্ষত-বিক্ষত প্রাণীর রক্তাক্ততার মতো জীবন এই শহরে অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। কবি-ভাষ্য স্মর্তব্য : চোখে মোর মুছে যায় ব্যাধবিদ্ধা ধরণীর রুধিরলিপিকা। (নীলিমা) ‘পিরামিড’ কবিতায় মিশরের পিরামিড’ যে সভ্যতার স্মৃতিস্মারক হিসেবে ইতিহাসে বহমান—সে কথা কবি স্মরণ করিয়ে দিয়ে যুগের রক্তাক্ততার বাতাবরণকেও এতে চিহ্নিত করেছেন। ‘ধূম্রমৌন সন্ধ্যায় নবদিবসের যেমন মৃত্যুঘন্টা বাজে; তেমনি শতাব্দীর মৃতদেহে কবি শ্মশানের ভস্মবহ্নি জ্বলতে দেখেন। সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তে ক্ষুদ্ররাষ্ট্রগুলো চিতার কবলে পড়ার মতো দুর্বিসহ হয় : পান্থ ম্লান চিতার কবলে একে-একে ডুবে যায় দেশ জাতি সংসার সমাজ। ... ... পিরামিড-পাষাণের মর্ম ঘেরি নেচে যায় দু-দণ্ডের রুধির ফোয়ারা। সময় এবং অসংখ্য আগন্তুক পিরামিডের কাছে তাদের ‘অসংবৃত অন্তরের কথা' বলে যায়; অথচ পিরামিডরূপী সভ্যতাস্মারক নিরুত্তর নিশ্চল ও মৌন থাকে : তুমি রহো নিরুত্তর-নির্বেদী-নিশ্চল মৌন-অন্যমনা; প্রিয়ার বক্ষের ‘পরে বসি’ একা নীরবে করিছ তুমি শবের সাধনা- সভ্যতার দুর্বিসহ বাস্তবতার স্মারকবাহী এই পিরামিড হলো ইতিহাসও মানবের অর্জন ও অর্জনের প্রতীক। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির সিম্বল। কবি তাঁর 'সেদিন এ-ধরণীর' কবিতায় ‘বনের ছায়ার নিচে’ কার ভিজে চোখ ভেসেছিল, তা খেয়াল করেননি; কারণ অতিদূর তারকার কামনায় বা সৌন্দর্য-সন্ধানে কবির অন্তরের চোখ সেদিন খুলে
জন্ম-(ফেব্রুয়ারি ১৮, ১৮৯৯ - বঙ্গাব্দ ফাল্গুন ৬, ১৩০৫ - কার্তিক ৫, ১৩৬১) ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাঙালি কবি, লেখক, প্রাবন্ধিক এবং অধ্যাপক। তাকে বাংলাভাষার "শুদ্ধতম কবি" বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অগ্রগণ্য। মৃত্যুর পর থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর শেষ ধাপে তিনি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেন এবং ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে যখন তার জন্মশতবার্ষিকী পালিত হচ্ছিল ততদিনে তিনি বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তম কবিতে পরিণত হয়েছেন। তিনি প্রধানত কবি হলেও বেশ কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা ও প্রকাশ করেছেন। তবে ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে অকাল মৃত্যুর আগে তিনি নিভৃতে ২১টি উপন্যাস এবং ১০৮টি ছোটগল্প রচনা গ্রন্থ করেছেন যার একটিও তিনি জীবদ্দশায় প্রকাশ করেননি। তাঁর জীবন কেটেছে চরম দারিদ্রের মধ্যে। বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধকাল অনপনেয়ভাবে বাংলা কবিতায় তাঁর প্রভাব মুদ্রিত হয়েছে। রবীন্দ্র-পরবর্তীকালে বাংলা ভাষার প্রধান কবি হিসাবে তিনি সর্বসাধারণ্যে স্বীকৃত। তাকে বাংলাভাষার শুদ্ধতম কবি অভিধায় আখ্যায়িত করা হয়েছে। তিনি (অক্টোবর ২২, ১৯৫৪ -বঙ্গাব্দ কার্তিক ৫, ১৩৬১ ) সালে মৃত্যু বরণ করেন।