"মুসলিম বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য" বইয়ের ভূমিকা থেকে: এ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত প্রবন্ধগুলি ইতিহাস ও ঐতিহ্য—এ দু'ভাগে ভাগ করা যায়। ইতিহাসের চারটি প্রবন্ধই ইতিহাসের আকর-গ্রন্থের মূল্যায়ন। আকর-গ্রন্থগুলি প্রায়ই দুষ্প্রাপ্য এবং ইংরেজি জানেন না এরূপ বাংলা ভাষার গবেষকদের নাগালের বাইরে। আলােচ্য ১, ২ এবং ৪ সংখ্যক আকর-গ্রন্থের বর্ণিত বিষয় সমসাময়িক লেখকদের চাক্ষুষ বিবরণ। প্রথম গ্রন্থের লেখক আবদুল লতীফ সুবাদার ইসলাম খান চিশতীর রাজমহল থেকে ঘােড়াঘাট যাওয়ার পথে সুবাদারের সফরসঙ্গী ছিলেন এবং তিনি পথে সুবাদারের কার্যকলাপের বিবরণ দেন। সুবাদারের কার্যকলাপ ছিল বাংলার ভূঞাজমিদারদের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন। ইসলাম খান বাংলার মােগল কর্তৃত্ব স্থাপনের পরিকল্পনা করেন এ সফরের সময়। সমসাময়িক ইতিহাস মিরযা নাথনের বাহবৃস্তান-ই গায়বী’তে এ বিষয়ে অনেক কিছু পাওয়া গেলেও আবদুল লতীফের বিবরণে প্রাপ্ত খুঁটিনাটি বিষয় অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। মুহাম্মদ মাসুম লিখেন তারীখ-ই শাহ শুজাই। তিনি শাহ শুজার বিশ্বস্ত অনুচর ছিলেন, তাঁর গ্রন্থের বিষয়বস্তু শাহজাহানের পুত্রদের মধ্যে উত্তরাধিকারের যুদ্ধ। লেখক শুজার অনুচর হলেও তার বিবরণ নিরপেক্ষ প্রমাণিত হয়। উত্তরাধিকারের যুদ্ধ সম্পর্কে তাঁর গ্রন্থেই সর্বপ্রথম লিখিত হয়। এই প্রবন্ধে ঐতিহাসিক হিসাবে তার মূল্যায়ন করা হয়েছে। ৪ সংখ্যক প্রবন্ধ গৌড়-পাওয়ার ইতিহাস সৈয়দ এলাহী বখস রচিত ‘খুরশীদ জাহান নুমা’ গ্রন্থের সার সংক্ষেপ এ প্রবন্ধে অনূদিত হয়েছে। এ গ্রন্থে লেখক অনেক প্রাচীন শিলালিপি সংগ্রহ করে পাঠোদ্ধার করে প্রকাশ করেন। এ শিলালিপিগুলি এলাহী বখসের পুস্তককে সমসাময়িক পুস্তকের মর্যাদা দিয়েছে। তাই পুস্তকের গুরুত্ব উপলব্ধি করে এ প্রবন্ধ এখানে সন্নিবেশিত হয়েছে। ৪ সংখ্যক প্রবন্ধ লিখেন একজন অজ্ঞাতনামা ওলন্দাজ নাবিক, তিনি মীর জুমলার আসাম অভিযানে অংশ নেন, সুতরাং তিনি শুধু সমসাময়িকই নন, প্রত্যক্ষদর্শীও বটে। এই দেশের যুদ্ধ সম্পর্কে একজন বিদেশীর চাক্ষুষ বিবরণ পাওয়া অবশ্যই চিত্তাকর্ষক, অতএব আকরগ্রন্থ হিসাবে এ চারটি গ্রন্থেরই বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে এবং তাই এ চারটি প্রবন্ধ এই সংকলনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ঐতিহ্য বিষয়ে চারটি প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে—এ প্রবন্ধগুলি বাংলার মুসলমান আমলের ইতহাসের জ্ঞান প্রসারিত হওয়ার সহায়ক। প্রথম প্রবন্ধ বাংলায় মুসলমান সূফীদের ভূমিকা নিয়ে লিখিত। ইসলামে সূফীবাদ আন্তর্জাতিক সংস্থা, সূফীবাদ ভৌগােলিক সীমারেখায় আবদ্ধ থাকে না। সূফীবাদের অভ্যুদয় বাঙলার বাইরে হলেও বাংলাদেশে এই মতবাদ জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং এখনও বাংলাদেশে সূফীবাদ জনপ্রিয়। তাই সূফীরা বাংলার সমাজে কীভাবে প্রভাব বিস্তার করে সেই বিষয়ে এ প্রবন্ধটি লিখিত। ৬ সংখ্যক ও ৭ সংখ্যক প্রবন্ধ দু’টিও মুসলমানদের ধর্মীয় শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে লিখিত। শেষ প্রবন্ধটি সমুদ্রগর্ভে বিলীন একটি পর্তুগীজ শহর সম্পর্কে লিখিত, পর্তুগীজ জলদস্যুদের ললামহর্ষক কাহিনীও এই প্রবন্ধে পাওয়া যায়। সবগুলি প্রবন্ধ গবেষকদের কাজে আসবে বলে আমার বিশ্বাস।
প্রফেসর আবদুল করিম চট্টগ্রামের বাঁশখালী থানায় এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে ১৯২৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামে প্রাথমিক ও জুনিয়র মাদ্রাসা শিক্ষা সমাপ্ত করে তিনি চট্টগ্রাম ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমান মহসিন কলেজ) থেকে ১৯৪৪ সালে হাই মাদ্রাসা ও ১৯৪৬ সালে আই. এ. পাশ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৯ সালে ইতিহাসে বি. এ. অনার্স ও ১৯৫০ সালে ঐ একই বিষয়ে এম. এ. পাশ করেন। ১৯৫১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে লেকচারার হিসেবে যােগদান করেন। তিনি ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এবং ১৯৬২ সালে। লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি. এইচ-ডি ডিগ্রি লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থিসিসের বিষয় ছিল ‘সােশ্যাল হিস্টরি অব দি মুসলিমস্ ইন বেঙ্গল’ এবং লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে থিসিসের বিষয় ছিল মুর্শিদকুলী খান এ্যান্ড হিজ টাইমস্ । ১৯৬২ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রীডার পদে উন্নীত হন। ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগের রীডার ও প্রফেসর পদে উন্নীত হন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি আলাওল হলের প্রভােস্ট এবং কলা অনুষদের ডীনের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত উপাচার্যের পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি কয়েক বৎসর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ-এ সিনিয়র ফেলাে এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সুপার নিউমারারী অধ্যাপক পদেও কর্মরত ছিলেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি বহু দেশও ভ্রমণ করেছেন। তিনি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইমেরিটাস ছিলেন। ২০০৭ সালের ২৪শে জুলাই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।