বদরুদ্দীন উমর রচনাবলী খণ্ড ৯-এ বঙ্গভঙ্গ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি (উমর ১৯৮৭ গ), বাঙলাদেশের মধ্যবিত্ত ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি (উমর ১৯৮৯ ক), বাঙলাদেশে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার (উমর ১৯৮৯ খ), পশ্চাদপদ দেশে গণতন্ত্রের সমস্যা (উমর ১৯৯০ ক) এবং বিপ্লব ও প্রতিবিপ্লব (উমর ১৯৯০ খ) Ñ এই পাঁচটি গ্রন্থ সঙ্কলিত হয়েছে। এ গ্রন্থগুলি সময়ব্যাপ্তির দিক দিয়ে ১৯৮৭ থেকে ১৯৯০ এই চার বছরে প্রকাশিত। ভারতের রাজনীতিতে এবং সমাজে সম্প্রদায় ও ধর্মভিত্তিক বিভাজন শোষণ-শাসনের একটি পরিচিত হাতিয়ার যাকে প্রতিরোধে সহযোগিতা করার লক্ষ্যে বঙ্গভঙ্গ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি গ্রন্থের চিন্তাগুলি প্রকাশ করা হয়েছে। উমর উল্লেখ করেছেন, “পাকিস্তান আন্দোলনের মাধ্যমে যে নীতির ভিত্তিতে ভারত বিভক্ত হয়েছিলো ঠিক সেই একই সাম্প্রদায়িক নীতির ভিত্তিতে বিভক্ত হয়েছিলো বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙলা এবং সেই সঙ্গে আসাম ও পাঞ্জাব। এবং এই সব বিভক্তি সম্ভব হয়েছিলো দেশীয় পরিস্থিতির মধ্যে বিদ্যমান কতকগুলি অবৈরী দ্বন্দ্বের উপস্থিতি এবং সেই দ্বন্দ্বগুলিকে বৃটিশ শাসন কর্তৃক বৈরী দ্বন্দ্বে পরিণত করার মাধ্যমে। এই সাম্প্রদায়িক ভেদনীতির ফলে বৃটিশ ভারতের হিন্দু, মুসলমান, শিখ ইত্যাদি প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায়ভুক্ত লোকরাই বৃহত্তর অর্থে নিদারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন এবং সেই ক্ষতির জের তাঁরা আজও এক থেকে অন্য প্রজন্ম পর্যন্ত বহন করে চলেছেন।” (উর:৯:১৩) বাঙলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ তার অন্যতম সাংবিধানিক স্তম্ভ হলেও তা আওয়ামী লীগের বাগাড়ম্বরে পরিণত হয় এবং ধর্মের সাম্প্রদায়িক ব্যবহার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায় Ñ “চরিত্রগতভাবে আওয়ামী লীগের ‘গণতান্ত্রিক’ সরকার এবং পরবর্তীকালে জিয়াউর রহমান ও এরশাদের সামরিক সরকারের মধ্যে কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই।” (উর:৯:১৮৩) বাঙলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব ও ভারতের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ভেতরে যে সব বিভিন্নমুখী স্রোত রয়েছে সে দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে উমর বাঙলাদেশের ও ভারতের গণতান্ত্রিক ও বৈপ্লবিক সংগ্রামের স্বার্থে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ‘রাজনৈতিক সংগ্রাম’ সংগঠিত করার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন এবং ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করে ১৯৮৪ সালে লিখেছেন, ‘এ কাজে অবহেলা করলে ভারতে গণতান্ত্রিক এবং বৈপ্লবিক আন্দোলন সংগঠিত এবং সঠিক পরিণতির দিকে পরিচালনা করা একেবারেই অসম্ভব।’ (উর:৯:২১৭) বাঙলাদেশের মধ্যবিত্ত ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি (উমর ১৯৮৯ ক) গ্রন্থে পাকিস্তান আমলের বাঙালী মধ্যবিত্তের শ্রেণীস্তর সম্পর্কে উমর লিখেছেন “বাঙালি মধ্যবিত্ত বুর্জোয়ার একটি অংশের মধ্যে ‘জাতীয় বুর্জোয়ার’ একটা দুর্বল কিন্তু সুনির্দিষ্ট স্তর ছিলো। সে স্তর আজকের বাঙলাদেশে আর অবশিষ্ট নেই বললেই চলে। সেটা একেবার ভেঙে পড়েছে। এখনকার মধ্যবিত্ত একটি শ্রেণী হিসেবে পুরোপুরি দালাল চরিত্রের। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, বাঙলাদেশে আজ জাতীয় বুর্জোয়া চেতনাসম্পন্ন মধ্যবিত্তের কোনো অস্তিত্ব নেই। সেটা নয়। সে অস্তিত্ব এখন আছে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ানো।” (উর:৯:৯৯) সমাজের এহেন অবস্থায় সংস্কৃতির যে সঙ্কট সৃষ্টি হয় এ গ্রন্থে সেই সব সংকট বিষয়ে পর্যালোচনা করা হয়েছে। পশ্চাদপদ দেশে গণতন্ত্রের সমস্যা (উমর ১৯৯০ ক) গ্রন্থে বলা হয়েছে, এ ধরনের দেশে সাধারণত সামরিক শাসন বা বেসামরিক স্বৈরতন্ত্রী শাসন প্রতিষ্ঠিত রয়েছে; এসব দেশ সাম্রাজ্যবাদ কবলিত। এই বাস্তবতায় গণতন্ত্রের সমস্যা ও তার থেকে উত্তরণের পথ কী হতে পারে সে বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এসব দেশে যেমন বাঙলাদেশে “নিজেদের সংগ্রাম সংগঠিত করতে গেলে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক কিছু অধিকারের জন্য তাকে সংগ্রাম নিশ্চয়ই করতে হবে – মত প্রকাশের অধিকার, সভা সমিতি মিছিলের অধিকার, প্রচার প্রচারণার অধিকার ইত্যাদির জন্য লড়তে হবে। কিন্তু সেটাই তার সংগ্রামের শেষ কথা নয়। তার আসল সংগ্রাম হলো, জীবন জীবিকার মূল চাহিদাগুলো ঠিকমতো পূরণের সংগ্রাম। তার খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদি সঠিকভাবে পাওয়া ও নিশ্চিত করার সংগ্রাম। এই সংগ্রামে তাই বুর্জোয়া গণতন্ত্র এবং সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র উভয়েরই উপাদান উপস্থিত থাকে। কিন্তু এই সংগ্রামের মূল লক্ষ্য থাকে সমাজতন্ত্রের দিকে। এ কারণেই এই গণতন্ত্রকে বলা হয় জনগণের গণতন্ত্র বা জনগণতন্ত্র।” (উর:৯:২৯১-৯২) এ খণ্ডে সঙ্কলিত বিপ্লব ও প্রতিবিপ্লব (উমর ১৯৯০ খ) গ্রন্থে উমর লিখেছেন, কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিবিপ্লবী নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্ব ইউরোপে ‘প্রতিবিপ্লবের এক প্রবল স্রোতধারা সৃষ্টি হয়েছে এবং এখনো অব্যাহত আছে।’ (উর:৯:৩৭৩) বিষয়টির সাথে সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক রাজনীতি, আঞ্চলিক রাজনীতি এবং দেশের রাজনীতি ও সমাজতন্ত্রের ভাবমূর্তি Ñ যা সমসাময়িক ভূ-রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বিপ্লব ও প্রতিবিপ্লব গ্রন্থে এ সব বিষয় সম্পর্কে ১৪টি প্রবন্ধ রয়েছে। এ গ্রন্থের একদিকে ‘সিপিবিতে নতুন লোকের যোগদান ও ভাঙন প্রসঙ্গে’, ‘খোলা হাওয়ার মাহাত্ম্য’ ইত্যাদি প্রবন্ধে বিলোপবাদী এবং আওয়ামী লীগের ‘কন্ট্রাক্টর’ ও ‘সাব-কন্ট্রাক্টর’দের রাজনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে আলোচিত হয়েছে; অন্যদিকে স্ট্যালিন ও মাও সেতুঙের অবদান বিষয়ে আলোচিত হয়েছে। সর্বোপরি সাম্রাজ্যবাদের ও তাদের এজেন্টদের স্বার্থের সাথে বর্তমানে জনগণতান্ত্রিক আন্দোলনের যে সংগ্রাম-যুদ্ধ তাকে শাণিত করার জন্য প্রাসঙ্গিক অনেকগুলি বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
আফজালুল বাসার ২৪-০৭-১৯৫৭ তারিখে সাতক্ষীরা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আবদুস সােবহান এবং মাতার নাম মােসাম্মৎ রাহিলাতুন্নেসা। তিনি ১৯৮১ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি, দর্শন ইত্যাদি তাঁর গবেষণা ও লেখাপড়ার এলাকা। সাম্প্রতিক সাহিত্যতত্ত্ব চর্চায় তিনি একজন। অগ্রপথিক। তাঁর মৌলিক প্রবন্ধ গ্রন্থাবলি: বাঙলা সাহিত্য। সমালােচনা (১৯৯৩), অক্ষর পুরুষ (২০০২), বাঙালির স্বদেশ ও সংস্কৃতির অনুশিলন (২০০২), নজরুল ইসলামের সাহিত্য ভাবনা (২০০২), জহির রায়হান: এক বর্ণাঢ্য মুহূর্তের নায়ক (২০১২), বাঙালির অক্ষর, ভাব ও স্বভাব (২০১৩)। তাঁর সম্পাদিত পত্রপত্রিকা ও গ্রন্থাবলি: অস্বীকার (৫টি সংখ্যা, ১৯৭৭-৭৯), আজমল স্মরণী (১৯৭৮), বিদায় স্মরণী (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের প্রথম ব্যাচ কোর্স পদ্ধতির ছাত্র ছাত্রীদের বিদায় স্মরণে, ১৯৮১), আহমদ শরীফ স্মারক গ্রন্থ (২০০১), অধ্যাপক আহমদ শরীফ শ্রদ্ধাঞ্জলি (২০০১), অধ্যাপক আহমদ শরীফ সাক্ষাৎকারে সমকাল (২০০২), স্বদেশচিন্তর মুখপত্র (২০০২), ট্রাকটেটাস ও ভিটগেনস্টাইনের ভাষাচিন্তা (২০০৩)। ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদ: কমিউনিজমের Gallo (Principles of Communism by f. Engels, 1986], নজরুল ইসলামের সাহিত্য জীবন, (Introducing Nazrul Islam by Serajul Islam Chowdhury : 1986, 2001], শিল্পকলা ও সমাজজীবন [Art and Social Life by G. V. Plekhanov, 1988, 2013], বিশ শতকের সাহিত্যতত্ত্ব। [Selected Essays on Mordern literary Theory by Western Writers : 1991, 2003], ভিটগেনষ্টাইনের ট্রাকটেটাস [Tractatus Logico-Philosophicus by L. Wittgenstein, 2001) কাব্যগ্রন্থ : নিম্নস্বরের কবিতা (২০১১), লিফট সিরিজ (২০১১), রঙিন পুতুল (২০১৩)। ছড়া ও গান : আহসানের ছড়া ও গান (২০১৩)।