সম্ভবত, বর্তমান সময়ে রাসুলের (সা.) একটি যথার্থ সীরাতের প্রয়োজনীয়তা বিশ্ব যেভাবে অনুভব করছে, ইতিপূর্বে তা আর কখনোই হয়নি। বিগত কয়েক দশক ধরেই ইসলামের প্রতি বিশ্বজুড়ে মানুষের আগ্রহ ব্যপকভাবে বেড়েছে। নতুন শতাব্দীতে এসেও ইসলামকে নিয়ে সেই সেই আগ্রহের ধারা অব্যহত রয়েছে। তবে, ইসলামকে নিয়ে এই বাড়তি কৌতুহল সবসময়ই যে ইতিবাচক কারনে তাও কিন্তু নয়। বিগত কয়েক যুগে ইসলামের পতাকাবাহী বলে দাবীদার কিছু মানুষ এই ঐশ্বরিক জীবনবিধানটির ভাবমুর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুন্ন করেছে। যদিও ইসলামের মুল বৈশিষ্ট্য ও বার্তার সাথে চরমপন্থার নূন্যতম সম্পর্কও নেই, তথাপি ইসলামের উপর জোর করে চরমপন্থী একটি ধারাকে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এই অপকর্মের সুযোগ আবার সেই অপশক্তিগুলো গ্রহন করেছে যারা ইসলামকে তার মুল পথ থেকে সবসময়ই বিচ্যুত করতে চেয়েছে। তারা নানা অন্যায় কাজের দায় ইসলামের উপর আরোপ করে ইসলামকে নেতিবাচকভাবে চিত্রায়িত করার প্রয়াস চালিয়েছে। আর বিশ্বমিডিয়া যারা সবসময় ‘টাটকা রোমাঞ্চকর খবরের’ খোঁজে ফিরে, তারাও যে কোন আলোচিত ধ্বংসাত্মক বা সন্ত্রাসী সংবাদের তথ্য পেলেই তার সাথে ইসলামকে জুড়ে দিয়ে মানুষের সামনে ইসলামকে নিন্দিত রূপেই উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছে। ইসলামকে প্রায়শই যে অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত করা হয় তাহলো সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসবাদ। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর এর মাত্রা আরো বৃদ্ধি পায়। তবে ১১ সেপ্টেম্বরের সেই ঘটনা থেকেই যে এর সূত্রপাত তা কিন্তু নয়। টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলা চালানোর কয়েক মাস আগেই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি চ্যানেলে একটি প্রতিবেদন প্রচারিত হয়। সেখানে মার্কিন কিছু দর্শককে প্রশ্ন করা হয়েছিল, যখনই তাদের সামনে ‘ইসলাম’ এর কথা বলা হয়, তখন সবার আগে কোন চিন্তাটি তাদের মনে আসে? অধিকাংশ দর্শকই বলেছিলেন সন্ত্রাসবাদ। আমাদের আরো মনে পড়ে, বছর কয়েক আগে যখন ওকলাহোমা শহরে কিছু বোমা বিস্ফোরন ঘটানো হয়, তার পরপরই মিডিয়া চ্যানেলগুলো যেন ইসলামের দিকে আঙ্গুল তোলার জন্য একরকম প্রস্তুত হয়েই ছিল। যদিও খুব দ্রুততম সময়েই ঘটনার তদন্ত শেষ হয় এবং জানা যায় যে, মুসলমান কেউ সেই হামলার সাথে জড়িত ছিলনা। ঐ ঘটনায় মুসলমানদের সম্পৃক্ততা প্রমান না হলেও যে বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে আমাদেরকে বিবেচনায় নিতে হবে তাহলো, মিডিয়ার একটা ইসলাম বিরোধী ধারনা আগে থেকেই ছিল। আর এরকম ধারনা বা মানসিকতা আরো অনেকের মধ্যেই আছে যারা সুযোগ পেলেই ইসলাম ও সন্ত্রাসবাদের মধ্যে সম্পর্ক খুঁজতে শুরু করে। কিন্তু যে যাই বলুক বা করুক, সত্য তার আপন মহীমায় উদ্ভাসিত হবেই। এটা চিরন্তন সত্য যে, বেসামরিক নাগরিকদের উপর সন্ত্রাসীরা যেভাবে হামলা চালায় ইসলাম তাকে গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে এবং এই ধরনের সন্ত্রাসীদের দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি হওয়া উচিত বলে মনে করে। ইসলাম সবসময় অপরাধের ধরন ও গুরুত্ব অনুযায়ী শাস্তি নির্ধারন করার পক্ষে। শাস্তি এতটা কঠিন হতে হবে যাতে ভবিষ্যতে একই অপরাধ অন্য অপরাধীরা করার সাহস না পায়। এই দৃষ্টিভংগি থেকেই ইসলাম অনেক অপরাধের শাস্তি প্রকাশ্যে কার্যকর করার বিধানও জারি করেছে। এতে করে একদিকে যেমন ন্যায়বিচার হয়েছে বলে সকলের সামনে প্রতীয়মান হয় ঠিক একইভাবে সম্ভাব্য অপরাধীরাও শাস্তির ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন হতে পারে। ইসলামের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, ইসলাম অপরাধ সংঘটনের আগেই তা নিয়ন্ত্রনের পক্ষে, যাতে সমাজে অপরাধের মাত্রা বেড়ে না যায়। অপরাধের বিরুদ্ধে ইসলামের যে অবস্থানের কথা এতক্ষন বলা হলো, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধেও ইসলামের অবস্থান একই রকম। অর্থাৎ সন্ত্রাসী কার্যক্রমকেও ইসলাম এমনভাবে মোকাবেলা করার পক্ষে যাতে এর দ্বৈত উদ্দেশ্যই সফল হয়। অর্থাৎ প্রথমত যারা সন্ত্রাস করেছে তারা যেন এর দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি পায় এবং দ্বিতীয়ত অন্য অপরাধীরা যেন এই শাস্তির ভয়াবহতা সম্পর্কে অবহিত হয়ে ভবিষ্যতে এই কাজটি করার আর সাহস না পায়। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা সভ্যতার সংঘাত নিয়ে অনেক কথা শুনছি। ইসলামকেও নানাভাবে পশ্চিমা সভ্যতার প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেয়া হচ্ছে এবং বলা হচ্ছে, এই দুই সভ্যতার মধ্যে ভীষন রকম ধ্বংসাত্মক একটি যুদ্ধ এখন অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও ইসলাম কখনোই কোন সভ্যতাকে ধ্বংসের কথা বলেনা। ইসলামের সোনালী যুগে, যখন ইসলাম বীরদর্পে বিশ্বের অনেক স্থানে পৌছে যাচ্ছিলো, তখনও সেই নতুন জায়গাগুলোর কৃষ্টি, সভ্যতা আর সংস্কৃতির সাথে কিন্তু ইসলাম খাপ খাইয়ে নিয়েছিল। ইসলাম প্রতিটি নতুন সংস্কৃতিকে তার মত করে মোকাবেলা করতো এবং ইসলামের তাওহীদ সংক্রান্ত যে মুল বার্তা সেটিকে ধরে রেখে বাকি যতটুকু পারা যায় স্থানীয় সংস্কৃতির সাথেই মিলে মিশে ইসলাম একাকার হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতো। এ কারনে আগে থেকে চলে আসা সভ্যতাগুলোর যতটুকু ভাল বৈশিষ্ট্য ছিল, ইসলাম তার সবটাকেই গ্রহন করতো। আর ততটুকুই বর্জন করতো যতটুকু মানব সমাজের জন্য কল্যানকর নয় কিংবা যতটুকু ইসলামের তাওহীদের চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক। এমনকি আরবের যে স্থানে ইসলামের পুনরুত্থান হলো, সেখানে কিন্তু প্রথাগতভাবেই মুর্তি পূজা হতো। তথাপি সেই যুগের মানুষের যে ভালগুনগুলো ছিল, সমাজের যে গঠনমুলক বৈশিষ্ট্যগুলো ছিল, ইসলাম তার সবগুলোকেই সাদরে বরন করে নিয়েছিল। এভাবে মানব উন্নয়নের মুল চেতনাকে ধারন করে ইসলাম ক্রমশ একের পর এক সভ্যতাকে জয় করে নিয়েছিল। ইসলাম এমন একটি দর্শন- যেখানে সব সময়ই ইতিবাচক চিন্তা ও ভাল পরিকল্পনাগুলোকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। ইসলাম বরাবরই নিপীড়নমুলক নীতি ও কৌশলকে বর্জন করে। পাশাপাশি, যা কিছু মিথ্যা, তার কোনটাই ইসলাম অনুমোদন করেনা।
Title
মুহাম্মাদ (সা.) দ্য ম্যান এন্ড দ্য প্রফেট - (১-৩ খণ্ড)