প্রথম অধ্যায় সরকারের সমস্যাবলী (Problems of government)
সমস্যা বলতে কী বুঝায় : (What is problem?) সাধারণত সমস্যা বলতে এমন কোনাে পরিস্থিতির উদ্ভবকে বুঝায় যা মানুষের জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিকূলতা বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, জাতীয়, আন্তর্জাতিক জীবনের সর্বক্ষেত্রে যে পরিস্থিতি মানুষের জীবন বিকাশে বাধার সৃষ্টি করে, সাধারণভাবে সেসব বিষয়কেই সমস্যা হিসাবে উল্লেখ করা যেতে পারে।
পৃথিবীর কোনাে রাষ্ট্র, সরকার বা সমাজই সমস্যামুক্ত নয়। আর. এম. ম্যাকাইভার (R.M. Maciver)-এর মতে সকল মানবিক সংগঠনের মধ্যে সরকারই সর্ববৃহৎ (government is the vastest of all human enterprises.)। বেসরকারি বা ব্যক্তিগত সংগঠনসমূহ যত বৃহৎই হােক না কেন (অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সমাজকল্যাণমূলক, ধর্মীয়) তা সরকারের মতাে এত ব্যাপক পরিমাণে বহুবিধ কার্য সম্পাদন করে না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রসরতা, বেসরকারি ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি, সাংস্কৃতিক জীবনের জটিলতা—সর্বক্ষেত্রেই সরকারের উপর প্রতিনিয়ত নতুন নতুন দায়িত্ব অর্পিত হচ্ছে। আধুনিক সরকারসমূহের প্রকৃতি ও স্বরূপ যাই হােক কেন, তাদের সমস্যাদি এত ব্যাপক ও জটিল যে, এসকল সমস্যাকে সুনির্দিষ্টভাবে একসাথে চিহ্নিত বা উল্লেখ করা যায় না, আবার অনেকক্ষেত্রে প্রকৃত সমস্যাকে চিহ্নিত করাও এক জটিল সমস্যা। সরকার যতই আধুনিকতামুখী হবে এবং মানুষের কল্যাণে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার যত বৃদ্ধি পাবে, সরকারের সমস্যা ততই বৃদ্ধি পাবে।
বিভিন্ন সরকারব্যবস্থায় সরকারের সমস্যা বিভিন্ন; উন্নত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলির সমস্যার প্রকৃতিও ভিন্ন ভিন্ন; তবে সরকারব্যবস্থায় যে সমস্যাটি বড় সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়, তা হল শাসনকর্তত্ব ও স্বাধীনতার মধ্যে সন্তোষজনক সমন্বয় সাধন করা। এই সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানের উপর ব্যক্তির কল্যাণ ও রাষ্ট্রের অস্তিত্ব উভয়ই নির্ভর করে বলে R.G. gettell মনে করেন। তিনি বলেন, “আদর্শ পরিবেশ সৃষ্টির স্বার্থে ব্যক্তির স্বার্থরক্ষার মতাে যথেষ্ট নাগরিক স্বাধীনতা থাকা উচিত এবং এমন একটা সরকারও থাকা উচিত যার আদেশগুলাে সুনির্দিষ্টভাবে প্রকাশ ও কর্তৃত্বমূলকভাবে কার্যকর হয়। কর্তৃত্ব ও স্বাধীনতার মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক পদ্ধতি ও উপায় নিয়ে প্রচেষ্টা চালানাে হয়েছে। কিন্তু এইগুলি প্রায়শই স্বৈরতন্ত্রে বা নৈরাজ্যবাদে পর্যবসিত হয়েছে।” তিনি আরও বলেছেন, “যে ব্যবস্থায় জনগণকে একটি স্বাধীনতাক্ষেত্ৰই প্রদান করা হয় না—উপরন্তু কর্তৃত্বের একটি অংশও প্রদান করা হয়, সে ব্যবস্থাই সবচাইতে সন্তোষজনক বলে প্রমাণিত। এককথায়, যে ব্যবস্থায় জনগণ সরকারের মতােই সেই সকল অধিকার সৃষ্টি ও কার্যকর করে, যা নাগরিক হিসাবে তারা ভােগ করতে পারে। অর্থাৎ তারা নিজেরা নিজেদের শাসন করে। যে সকল জাতি তাদের জনজীবনের বিষয়াদি পরিচালনায় সমর্থ, সেই সকল জাতির জন্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রই সর্বাপেক্ষা সন্তোষজনক জীবনব্যবস্থা। কারণ এরূপ রাষ্ট্রেই জনকল্যাণের সাথে সংগতিপূর্ণ সর্বাধিক স্বাধীনতা প্রদান করা হয়। | অধ্যাপক গেটেল মনে করেন, রাষ্ট্র অবশ্যই জনগণের রাজনৈতিক অধিকার এমন ভাবে সংকোচন করবে না যাতে স্বৈরতন্ত্রের সৃষ্টি হয়—আবার এমনভাবে সম্প্রসারণও করবে না যাতে অযোেগ্য উচ্ছখল জনতার শাসন কায়েম হয়। রাষ্ট্র অবশ্যই নাগরিক অধিকার এমনভাবে সম্প্রসারণ করবে না যাতে সরকারের কর্তৃত্ব ধ্বংস হয়, এবং অরাজকতার সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্র অবশ্যই নাগরিকদের অধিকার এমনভাবে সীমিত করবে না যাতে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ মাত্রাতিরিক্তভাবে কায়েম হয় এবং স্বৈরতন্ত্রের পথ প্রশস্ত হয়।
অধ্যাপক গেটেলের অভিমত বিশ্লেষণে এ-কথা সুস্পষ্ট যে, রাষ্ট্র তথা সরকারের প্রধান কাজ হল, যা সমস্যা সৃষ্টির পথকে প্রতিহত করতে সক্ষম হবে, তা হল নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের নীতি প্রয়ােগ করা। অর্থাৎ যার যতটুকু করণীয়, যতটুকু বর্জনীয়, যতটুকু প্রাপ্য তা যদি সঠিকভাবে পালিত হয় অর্থাৎ সরকার ও জনগণ যদি সঠিক অবস্থানে থেকে, নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে থেকে, পরস্পরের মধ্যকার নির্দিষ্ট সম্পর্ক বজায় রেখে, নির্দিষ্ট কার্যাদি ও দায়িত্ব পালন করে যায় তবে সরকার অনেক অযাচিত ও অপ্রত্যাশিত সমস্যা থেকে রেহাই পেতে পারে।
সরকার যদি রাষ্ট্রীয় জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন এবং তা যথাযথভাবে পালন ও কার্যকর করার পথসৃষ্টি করে তবে জনগণও সঠিক পথে পরিচালিত হবার দিকনির্দেশনা ও সুযােগ পাবে। নিজ নিজ দায়িত্ব, কর্তব্য, অধিকার ও ঔচিত্যবােধ একজন মানুষকে পূর্ণতা প্রদান করে। এরূপ মানুষ যারা মানবসম্পদ হিসাবে গণ্য হতে পারে তারাই কল্যাণকর রাষ্ট্রের তথা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
অবশ্য সরকারের সমস্যার সমাধানের জন্য শুধুমাত্র উন্নতশ্রেণীর মানুষ সৃষ্টিই . যথেষ্ট নয়। সুশিক্ষিত, দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন, অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বয়ম্ভর জাতি মাত্রই সমস্যামুক্ত এ-কথা বলা যায় না। ঐসব উন্নত রাষ্ট্রের সমস্যা অনুন্নত রাষ্ট্র অপেক্ষা ভিন্নতর। নৈতিকতা, মানবিক মূল্যবােধ সবকিছুর ক্ষেত্রেই উন্নত-অনুন্নত রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে বিশাল পার্থক্য বিদ্যমান। ফ্রি সেক্স, ফ্রি মিক্সিং, লিভিং টুগেটার ইত্যাদি বিষয় তথাকথিত সভ্যজাতিকে মানবজীবনের পবিত্রতা থেকে বিচ্যুত করছে। পরিবারের ভাঙন, অবৈধ সন্তানের জন্ম এবং রাষ্ট্রকতুক এসবের স্বীকৃতি সামাজিক অবক্ষয়কে এমন এক পর্যায়ে পৌছে দিয়েছে, যেখান থেকে সুস্থ পারিবারিক ও সামাজিক ব্যবস্থা প্রবর্তন কঠিন ব্যাপার। কুমারী মায়ের সন্তানেরা স্বাভাবিকভাবেই আদরস্নেহ বঞ্চিত হয়ে বড় হয় বিধায় তাদের মধ্যে প্রায়শ অসুস্থ অসংযত মানসিকতা সৃষ্টি হয়। ফলাফল হয় ভয়াবহ। মারাত্মক অপরাধপ্রবণতা সৃষ্টি হয়। লাগামহীন বেপরােয়া জীবনে অভ্যস্ত এইসব বেড়ে-ওঠা শিশু-কিশােররা সমাজে দৃষ্টান্তবিহীন অপরাধ ঘটায়। এসব ব্যাপারে ঐসব উন্নত রাষ্ট্রের সরকারগুলাে জটিল ও কঠিন সমস্যারমুখােমুখি হচ্ছে।
সামাজিক বা রাজনৈতিক সমস্যাই নয়, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও নানাবিধ সমস্যা প্রকারের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। হারমান হিলার (Herman Heller) বলেছেন, “রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার মধ্যকার সম্পর্ক আধুনিক রাষ্ট্রশাসনের সর্বাপেক্ষা প্রকট সমস্যা।” আধুনিক রাষ্ট্রসমূহে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে যে নতুন প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হয়েছে, সেগুলাে এমন কতগুলি সমস্যার সৃষ্টি করছে যে, সেগুলাের ব্যাপারে রাষ্ট্রকে হস্তক্ষেপ করতে হয়।
| রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক মন্দা উভয় ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রকে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। বর্তমানের পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহে ব্যক্তিমালিকানাধীন শিল্পকলকারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণহীনতায় সরকার হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয়। অনিয়ন্ত্রিত লাগামহীন পুঁজিবাদের বিকাশের ক্ষেত্রে সরকারের অমনোেযােগিতা নানাবিধ সমস্যার সৃষ্টি করছে। শ্রমিক অসন্তোষ, অপরিকল্পিত উৎপাদন, আমদানিরপ্তানি, উৎপাদিত সামগ্রীর কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ কতটুকু হওয়া উচিত—এসকল ব্যাপারে সবসময়ই রাষ্ট্রকে সচেতন থাকতে হয়। অন্যথায় রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক অরাজকতা সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকে। অনেকসময় কতকগুলি অত্যাবশ্যকীয় সেবার সরবরাহ অব্যাহত রাখার বিষয়ে বিশেষ সমস্যা দেখা দেয়। যদিও এই সকল সেবা সরবরাহ বেসরকারি উদ্যোক্তাদের জন্য খুবই জটিল বিষয়, কিন্তু এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, এগুলি সরবরাহকারীদের হাতে অনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় ছেড়ে দেয়া যায় না। এসব ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত মজুতদারির মাধ্যমে পণ্যসামগ্রীর কৃত্রিম সমস্যা সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকে। এসব সমস্যা সাময়িক হলেও মুদ্রাস্ফীতি, দুর্ভিক্ষ, অভাব অনটন সৃষ্টি করতে পারে, যা সরকারের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। | পুঁজিবাদী গণতন্ত্রে ব্যক্তি-উদ্যোক্তাদের প্রতিযােগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং রাষ্ট্রীয় বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে তাদের বিপুল প্রভাব সরকারের রাজনৈতিক কার্যক্রমে সমস্যা সৃষ্টি করে। এইসব শিল্পোদ্যোক্তাগণ চাপ সৃষ্টিকারী গােষ্ঠী হিসাবে সরকারের ওপর বিপুল প্রভাব বিস্তার করে। | উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর প্রতুলতা বা অপ্রতুলতা, বাজার নিয়ন্ত্রণ, অর্থের অবমূল্যায়ন প্রভৃতি বিষয়েও সরকারকে নানাপ্রকার জটিল সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় । শিল্পমালিক অর্থাৎ নিয়ােগকর্তা ও নিয়ােগপ্রাপ্ত কর্মচারীদের মধ্যে নানাপ্রকার অসন্তোষ,