মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালজয়ী সাহিত্য পুতুলনাচের ইতিকথা (১৯৩৬), শহরবাসের ইতিকথা (১৯৪৬), ইতিকথার পরের কথা (১৯৫২) এই তিনটি উপন্যাসকে ত্রয়ী হিসেবে আখ্যায়িত করা হলেও এতে অভিন্ন চরিত্রের কোনো উপ্যাখান বর্ণিত হয়নি। বহুল পঠিত উপন্যাস পুতুলনাচের ইতিকথা পঠনের পর পাঠকের হৃদয় হয়তো খুঁজবে শশী ডাক্তারকে, চপলা কুসুমকে। তাদের পরিণতিকে। কিন্তু লেখক যেন চেয়েছেন অপূর্ণতার মাঝেই বেঁচে থাকুক পুতুলনাচের পুতুলেরা। তবে তিনি পাঠককে বঞ্চিত করেননি কোনো অংশেই। গ্রামীন মৃত্তিকার গন্ধ ছেড়ে তিনি পিচঢালা পথের উষ্ণতা ছড়িয়েছেন শহরবাসের ইতিকথায়। সে পথে হেঁটেছে তরুণ মোহন কিন্তু অভিজ্ঞতা বেড়েছে বয়োজেষ্ঠ পীতাম্বরের। চরিত্রসমূহের যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে এ খণ্ডে রচিত হয়েছে শহরকাব্য। লেখকের বিচক্ষণ লেখনশৈলীতে উচ্চাভিলাষী মোহনের মাঝে পাঠকের অবচেতন মন খুঁজে নেবে শশী ডাক্তারকে। অন্যদিকে ইতিকথার পরের কথায় বিলেত ফেরত শুভর দৃষ্টিতে গ্রাম ও শহরের মিতালিই যেন চিত্রিত। নন্দ, জগদীশ, লক্ষ্মী এদের মাঝে লেখক কোথাও যেন লুকিয়ে রেখেছেন তার পূর্ববর্তী বইয়ের মনস্তত্ত্ব। তবে ১৯৪৪ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যুক্ত হবার সুবাদে পুতুলনাচের ইতিকথার তুলনায় শহরবাসের ইতিকথা এবং ইতিকথার পরের কথায় মার্কসবাদের প্রভাব অধিক লক্ষণীয়। এই ত্রয়ী উপন্যাস কোনো চরিত্র নির্ভর ত্রয়ী নয়। বরং এই ত্রয়ী গাঁথা হয়েছে সমাজ ব্যবস্থার সুতোয়, রাজনৈতিক উপাদানে, গ্রাম-শহরের দ্বন্দ্বসঙ্কুল পটভূমিতে যার গিঁটে গিঁটে রয়েছে মানসিক টানাপোড়েন।
শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, মধ্যবিত্ত সমাজের কৃত্রিমতা, নিয়তিবাদ ইত্যাদি বিষয়কে লেখার মধ্যে তুলে এনে বাংলা সাহিত্যে যিনি অমর হয়েছেন, তিনি হলেন প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯০৮ সালের ১৯ মে বিহারের সাঁওতাল পরগনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, আর মানিক ছিলো তাঁর ডাকনাম। বাবার বদলির চাকরিসূত্রে তাঁর শৈশব, কৈশোর ও ছাত্রজীবন কেটেছে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে, যার ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের পটভূমিতে বিভিন্ন সাহিত্য রচনা করেছেন তিনি। প্রবেশিকা ও আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় গণিত বিষয়ে অনার্স করতে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এখানে পড়াশোনাকালে বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে তিনি 'অতসী মামী' গল্পটি লেখেন। সেই গল্পটি বিখ্যাত 'বিচিত্রা' পত্রিকায় ছাপানো হলে তা পাঠকনন্দিত হয় এবং তিনি সাহিত্যাঙ্গনে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি সাহিত্য রচনায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন, যার ফলে তাঁর পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং তিনি আর পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। তাঁর হাতে বাংলা সাহিত্যে এক বৈপ্লবিক ধারা সূচিত হয় ঐ সময়ে, যখন সারা পৃথিবী জুড়ে মানবিক বিপর্যয়ের এক চরম সংকটময় মুহূর্ত চলছে। কমিউনিজমের দিকে ঝুঁকে যাওয়ায় তাঁর লেখায় একসময় এর ছাপ পড়ে এবং মার্ক্সীয় শ্রেণীসংগ্রাম তত্ত্ব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র। ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণেরও প্রভাব লক্ষ্য করা যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র-তে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে 'পদ্মানদীর মাঝি', 'দিবারাত্রির কাব্য', 'পুতুলনাচের ইতিকথা', 'শহরতলি', 'চতুষ্কোণ', 'শহরবাসের ইতিকথা' ইত্যাদি বিখ্যাত উপন্যাস, এবং 'আত্মহত্যার অধিকার', 'হারানের নাতজামাই', 'বৌ', 'প্রাগৈতিহাসিক', 'সমুদ্রের স্বাদ', 'আজ কাল পরশুর গল্প' ইত্যাদি গল্পগ্রন্থ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা রচনার কিছু নিদর্শন থাকলেও সেগুলো তেমন উল্লেখযোগ্যতা অর্জন করেনি। অসামান্য এই কথাসাহিত্যিক মাত্র ৪৮ বছর বয়সে ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।