‘বিভ্রাট’ গল্পের ডা. মিনহাজ পুঁজিবাদী বিকাশের নাটবল্টুতে পরিণত হয়েছেন। কখন এবং কীভাবে হয়েছেন তা পাঠক সত্ত্বর উপলব্ধি করতে পারছেন। গল্পের বিবর্তনে পাঠক সচকিত, চেতনায় একটা ঝলক দিয়ে গেল। এক্ষেত্রে ডা. মিনহাজ পুঁজিবাদী হয়ে উঠলেন। ‘আরোগ্য’ গল্পেও দেখা গেল অবসরপ্রাপ্ত বিশ^বিদ্যালয় অধ্যাপক গোলাম রসুল চিকিৎসা ব্যবস্থার স্বেচ্ছাচারিতার শিকার, যার ইন্ধনে রয়েছে ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি। ‘রুস্তমজী’ গল্পের জামালপুলিশ আর বিহারী ড্রাইভার রুস্তমজীর মধ্যেকার টানাপোড়েনে ভেলকিতে পড়ে, পুলিশের ভয়ে বেআইনি হুকুম তামিল করতে বাধ্য হয় ডাক্তার মধ্যবিত্তের সম্ভাবনা থাকে বিপ্লবী হবার, আবার পুঁজিবাদী হবারও। গল্পগুলি বহুমাত্রিক যদিও উপরের বক্তব্য কেবল একটি দিক নিয়ে। ‘বাসাবাড়ির বাসিন্দা’ তৎকালীন বহুল প্রচারিত সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশ হয়েছিল ১৯৮২ সালে। শিলু-ফারুকের সংসার নতুন বড় বাসায় শিফ্ট করা সম্ভব হয়নি টানাটানির জন্য। পাশের কামরার প্রতিবেশী প্রাক্তন ফোরম্যান বর্তমান ঘড়ি ম্যাকানিক, তার অদৃশ্য উপস্থিতি নিম্নমধ্যবিত্তের সংসারে আলোছায়া ফেলে। ‘দুয়ার বন্ধ’ গল্পে জেলাভিত্তিক রাজনৈতিক নেতাদের আধিপত্য আসলে সামগ্রিক বুর্জোয়া রাজনীতিরই চেহারা। এখানে শিক্ষিতের উপর অশিক্ষিত, দুর্বলের উপর পেশীধারী, সাধারণ মানুষের উপর মূর্তিধারণকারী নেতা আবির্ভূত হয় যেন দানব হিসেবে। জীবনধারণ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে, রাজনীতি হয়ে পড়ে আবিল। ‘যাত্রা’ গল্পটি প্রতীকীও বটে। কারণ যাত্রাটি শুধু যে ট্রেন যাত্রা তা নয়, জীবনযাত্রাও বটে। প্রগতির শক্তির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণও বটে। সীমান্ত ঘেঁষা ট্রেনে যারা ছিটেফোঁটা এপার-ওপার ব্যবসা করে তাদেরই একজন এক শাড়ী ব্যবসায়ী গায়ে লুকিয়ে ভারতীয় শাড়ি আনছিল পুলিশ তাকে অনাবৃত করে ছেড়েছে। খুলতে বেশী সময় লাগেনি। দ্রৌপদীর অনন্ত শাড়ী পরা ছিল না তার, ফলে প্রকাশ হয়ে পড়ে নগ্নমূর্তি। এই নগ্নিকা যেন পুরোদেশ। গল্পটিতে একটি চাবুকের শক্ত দাগ রয়েছে। ‘বনের ডাক’ গল্পে বনের যে ডাক আছে, সে ডাক শুনেছিলেন লেখক। এই ডাকটিকে কেন্দ্র করে একটি গ্রামের ছবির মাধ্যমে সমাজব্যবস্থার বৈষম্য চিত্রিত হয়েছে। গল্পের মূল আবেদন আরও ব্যাপক। আটটি গল্প আটরকম স্বাভাবিক এদের কেন্দ্রীয় আবেদন অভিন্ন। সবগুলোতে মধ্যবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্তের সমাজচিত্র এসেছে, সমাজব্যবস্থার কুৎসিত চেহারার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন লেখক। লেখক সমাজসচেতন। আজকের সময়ে প্রগতিপন্থী লেখক সহসা মেলে না। পাভেল চৌধুরী উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। যাঁরা বলেন প্রগতিশীল সাহিত্যিক নেই, তাঁদের বলি পাভেল চৌধুরীর মাথায় মুকুট পরিয়ে দিন। তিনি স্লোগান দেননি, রূপস্রষ্টা-কথাকার-কলাকার হিসেবে গল্প সাজিয়েছেন মমতা মাখিয়ে, বুদ্ধির ভিয়েনে কিন্তু নিরাচ্ছন্ন মস্তিষ্ক দিয়ে। ভাষা সহজ-সরল কিন্তু প্রাণবন্ত। নামকরণে এবং শব্দচয়নে তিনি আন্তরিক। গল্প বলিয়ে হিসেবেও কম যান না। সত্ত্বর পাঠককে আপন করে নিতে পারেন। প্লট সেট করেন যত্ন এবং সময় নিয়ে। তারপর ঝটিকা আক্রমণ চলে কলাদক্ষ নৈপুণ্যে। গল্পগুলির মোচড় সমৃদ্ধ। চরিত্রগুলি ঝকঝক করছে। তাই বলি, প্রগতিশীল সাহিত্য আন্দোলনে পাভেল চৌধুরী একবিংশ শতকের ত্রিশের দশকে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। এ নক্ষত্রের আলোয় শুধু পচাগলা পুঁজিবাদী সমাজকে চেনা যায় তা নয়, ঘুরে দাঁড়ানোর ইন্ধনও মেলে। ধন্য কথাসাহিত্যিক পাভেল চৌধুরী, ধন্য যশোহরি কলাবৃত্তি। আফজালুল বাসার