একজন প্রকৃত মুমিনের কাছে দুনিয়ার সব বন্ধনের চেয়ে, এমনকি তার জীবনের চেয়েও অধিক প্রিয় হলো নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। এ না হলে সে মুমিনই নয়। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহর অনুসরণের মাধ্যমে তাঁর প্রতি ভালবাসার প্রকাশ ঘটে থাকে। তাঁর আনুগত্যের নিক্তিতেই নবীপ্রেমকে পরিমাপ করা হয়। এর জন্য প্রয়োজন নবীজীর সীরাত পাঠ করা। কেননা সীরাতপাঠের মাধ্যমে মুমিনের জীবন প্রাণবন্ত হয়। মুসলিমজীবনে বিশুদ্ধ আকিদা ও চেতনার প্রভাব পড়ে। ঈমানী শক্তিতে বলিয়ান করে তোলে। সীরাত হলো মুসলিম উম্মাহর সামগ্রিক জীবনের আলোকবর্তিকা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সীরাত বা জীবনচরিত্র এত বিস্তৃত যে, একটি গ্রন্থে তার সূচি নিয়ে আলোচনা করলেও তা শেষ হবে না। তবুও সীরাত বিশেষজ্ঞগণ নিজেদের ফাহম-বোঝ ও যোগ্যতা অনুসারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সীরাতকে গ্রন্থবদ্ধ করেছেন। ইমাম ইবনে হাজম রহ.-এর জাওয়ামেউস সীরাহ (অল্পকথায় পূর্ণাঙ্গ নবীজীবন) হলো সীরাতশাস্ত্রের একটি কালোত্তীর্ণ প্রামাণ্য গ্রন্থ। এতে তিনি সীরাতশাস্ত্রের শিক্ষার্থী, সংশ্লিষ্ট জ্ঞান অন্বেষণে অনুসন্ধিৎসু পাঠকদের সামনে বিশুদ্ধ উৎস থেকে অল্প কথায় নবীজীবনের পূর্ণ চিত্রকে পূর্ণাঙ্গরূপে উপস্থাপন করেছেন। ইমাম রহ.-এর রচনাবলির আলোচনায় এ গ্রন্থটির কথা উল্লেখ হয়েছে। তবে কোথাও এর নাম আস-সীরাতুন নববীয়্যা লিবনি-হাজম; আর কোথাও আল-জাওয়ামেউ লিবনি-হাজম নামে উল্লেখিত হয়েছে। তার এই জাওয়ামেউস সীরাহ গ্রন্থটির আলোচনাকে তিনভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগ : নবীজির নসবনামা, নবুওয়াত লাভ ও রেসালাত, মুজেযাসমূহ, হজ-উমরা, গুণাবলি, বরকতময় নামসমূহ, উম্মাহাতুল মুমিনিন, সন্তানাদি, পত্রাবলি, দূত-বাতার্বাহক, আমিরগণ, বন্ধুবান্ধব, খাদেমগণ, অনুপম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি বিষয়। দ্বিতীয় ভাগ : ঈমান আনার ক্ষেত্রে ‘সাবেকিনে আওয়ালিনের’ মর্যাদায় মহিমান্বিত সাহাবায়ে কেরাম ও পরবর্তী সময়ের ইসলাম গ্রহণকারীগণ। মুশরিকদের পক্ষ থেকে কঠোর নিযার্তনের মুখে পতিত সাহাবায়ে কেরাম, হাবশায় হিজরতকারীগণের বিবরণ, বয়কট ও আমুল হুজন, মেরাজ, আকাবার বায়আত, শত্রুতা ও কষ্ট দেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রগামী কাফেরগণ ইত্যাদি প্রসঙ্গ। তৃতীয় ভাগ : হিজরতের পরবতীর্ ঘটনাবলি। গাজওয়া ও সারিয়াসমূহ, শুহাদায়ে কেরাম, বিদায় হজ, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাত ইত্যাদি প্রসঙ্গ। গ্রন্থকার রহ. সীরাতুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নির্ভরযোগ্য পদ্ধতিতে খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। এজন্য আলেম সমাজের কাছে তার গ্রন্থটি ইলমুস সীরাহর অন্যতম উৎস হিসেবে সমাদৃত হয়ে আসছে। বেশ কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণে জাওয়ামেউস সীরাহকে একটি কালোত্তীর্ণ ও প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। • আন্দালুসিয়ান সীরাত সাহিত্যভান্ডার থেকে যেগুলো বর্তমান যুগ পর্যন্ত পৌঁছেছে, তন্মধ্যে এটি বেশ প্রাচীন। • গ্রন্থটি আন্দালুসিয়ান পরিবেশ ও রচনাশৈলীতে রচিত। • বিশুদ্ধ বর্ণনার প্রতি সজাগ ও সচেতন ব্যক্তির হাতে রচিত। • এতে লেখক রহ. সীরাতসংক্রান্ত বিশুদ্ধতম বর্ণনা উল্লেখ করেছেন। পাঠককে সহিহ ও তুলনামুলক দুর্বল রেওয়ায়েত নির্ণয়ের জটিলতায় না ফেলে শক্তভাষায় বলে দিয়েছেন, তার উল্লেখ করা বর্ণনাটিই সঠিক। • এতে বিভিন্ন জঈফ রেওয়ায়েত বা দুর্বল অভিমত সম্পর্কে বিশ্লেষণ করার পর তা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। • ঘটনার সন-তারিখ উল্লেখ করার সময় খুব সতর্কতা অবলম্বন করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হিজরতের মাস রবিউল আওয়ালকে ভিত্তি করে ঘটনার তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে; উমর রাযি. প্রবর্তিত হিজরি তারিখ (মুহাররম থেকে হিজরি বর্ষপুঞ্জি) অনুযায়ী ঘটনা উল্লেখ করেননি। উমর রাযি. কতৃর্ক প্রবর্তিত হিজরি বর্ষপুঞ্জিতে সব মুসলমানের ঐক্যমত রয়েছে। ইমাম ইবনে হাজম রহ.-এর নিজস্ব বর্ণনারীতি দ্বারা উমর রাযি. কতৃর্ক প্রবর্তিত হিজরি বর্ষপুঞ্জিকে অগ্রাহ্য করা হয়নি; বরং ঐতিহাসিক ঘটনাবলিকে নবীজির মদীনায় পদার্পনের দিনকে ভিত্তি করে সুবিন্যস্ত করা হয়েছে। এটি তার একান্ত ব্যক্তিগত রীতি হিসেবে মেনে নিতে হবে। • বিদায় হজ্জের প্রসঙ্গ ছাড়া অন্য কোথাও তিনি তার মাজহাবের (জাহেরি মাজহাব) আলোকে ঘটনা বিশ্লেষণ ও শরয়ি হুকুমের ব্যাখ্যা উল্লেখ করেননি। তবে একাধিক জায়গায় এমনসব বর্ণনা উল্লেখ করেছেন যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ সীরাতবিদগণের সেগুলো সম্পর্কে মতানৈক্য রয়েছে। • তিনি ছিলেন সীমাহীন আমানতদার ঐতিহাসিক ও সীরাতজ্ঞ। যাকিছু লিখেছেন, পুরোপুরি বিশ^াস ও ঘটনার বিশ্লেষণের পরই লিখেছেন। মোটকথা, ইমাম ইবনে হাজম রহ. রচিত জাওয়ামেউস সীরাহ গ্রন্থটি আন্দালুসিয়ান আরবীর নান্দনিক ভাষা সৌন্দর্য্য, উন্নত বাক্যবিন্যাস ও বিশুদ্ধ বর্ণনা গুণে সীরাতসাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থের স্থান দখল করে নিয়েছে। ঢাউস সাইজের বৃহদাকার সীরাতগ্রন্থগুলোতে সীরাতের অনেক তথ্য বিশৃংখল ও ঘটনার সঙ্গে যোগসূত্রহীনভাবে ছড়িয়ে রয়েছে, যা পড়তে গিয়ে সাধারণ পাঠকবর্গ ক্লান্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু জাওয়ামেউস সীরাহয় সেসব তথ্য খুব অল্পকথায় সুখপাঠ্য করে উপস্থাপিত হয়েছে।
ইমাম ইবনে হাজম রহ.-এর প্রকৃত নাম আলি। উপনাম আবু মুহাম্মদ। তবে তিনি ‘ইবনে হাজম’ নামে খ্যাতি লাভ করেন। তার পিতার নাম আহমদ। বনু উমাইয়ার কিছু লোক আন্দালুসিয়ায় আসার সময় ইবনে হাজম রহ.-এর পূর্বপূরুষগণও তাদের সঙ্গে ছিলেন। ইবনু হাজম আল-আন্দালুসি গ্রন্থে ড. আব্দুল হালিম উয়াইস লিখেছেন, ইবনে হাজমের বংশের মধ্য থেকে তার উর্ধ্বতন দাদা খালাফ ইবনে মাদান প্রথম আন্দালুসিয়ায় পা রাখেন। আন্দালুসিয়া বিজেতা মুসা ইবনে নুসাইরের বাহিনীর সঙ্গে তিনি ৯৩ হিজরিতে আন্দালুসিয়ায় আসেন। তিনি ৩৮৪ হিজরির রমজান মাসের শেষ দিন (মুতাবেক ৭ নভেম্বর ৯৯৪ ঈসায়ি) বুধবার ভোরে কুরতুবায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বংশ ছিল আন্দালুসিয়ার একটি অভিজাত বংশ। পিতা আন্দালুসিয়ায় উমাইয়া শাসকদের মন্ত্রী ছিলেন। বড় হয়ে তিনি নিজেও মন্ত্রী হয়েছিলেন। মর্মর ও মার্বেল পাথরের কারুকাজ, স্বচ্ছ পানির ফোয়ারা, উজ্জ্বল আলোর ব্যবস্থার আলিশান প্রাসাদ তিনি শৈশব যাপন করেন। উমাইয়া বংশের হাত থেকে ক্ষমতার বাগডোর বনু আমেরের হাতে চলে গেলে অন্যান্য আমির-উমারা ও উজিরদের মতো ইবনে হাজমের পিতাও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হন। ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্যময় পরিবারটি মুহূর্তে দরিদ্রতায় নিপতিত হয়। এর পরের দুঃসহ জীবন সম্পর্কে তিনি নিজেই বলে গেছেন অনেক কথা। জ্ঞান সাধনা শৈশবে কুরআনুল কারিম হিফজ করেন। এমনকি, কুরআনুল কারিমের অর্থও শেখেন। তৎকালীন সময়ে ভাষা সমৃদ্ধ করার অন্যতম একটি মাধ্যম ছিল কাব্য। বালক ইবনে হাজমও অনেক কবিতা মুখস্থ করে ফেলেন। লিখন পদ্ধতি শেখেন। কিশোর বয়সে তিনি সুফি প্রকৃতির বিদগ্ধ আলেম আল্লামা আবু আলি হুসাইন আল-ফাসি রহ.-এর কাছে দীনি শিক্ষার পাঠ নেন। ওই বয়সেই তিনি বিখ্যাত মুহাদ্দিস আহমদ ইবনে জাসুর রহ.-এর থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। শুরুতে ফিকহে মালেকির জ্ঞান আহরণ প্রথমে তার অধ্যয়নের বিষয়বস্তু ছিল মালেকি ফিকহ। কেননা তখন আন্দালুসে মালেকি ফিকহের ব্যাপক চর্চা ছিল। তা ছাড়া এটি রাষ্ট্রীয় ফিকহ হিসেবেও স্বীকৃত ছিল। এরপর তিনি মালেকি মাজহাব ছেড়ে কেন শাফেয়ি মাজহাব গ্রহণ করেছিলেন তার সঠিক কারণ উৎঘাটন না করা গেলেও, এটুকু অন্তত বলা যায়, তিনি অন্যান্য ইমামদের তুলনায় ইমাম শাফেয়ি রহ.-এর রচনাবলি অধিক পড়েছেন এবং প্রভাবিত হয়েছেন। (এরপর হয়েতা মুগ্ধ হয়ে শাফেয়ি মাজহাব গ্রহণ করেন।) কারণ, ইবনে হাজম রহ.-এর ভেতর সমালোচনা, জারহ এবং স্বাধীন চিন্তার গুণটি খুব প্রকট ছিল। হতে পারে মাজহাব ত্যাগ করার এটিও একটি কারণ। ফিকহে শাফেয়ির জ্ঞান আহরণ এরপর তিনি ফিকহে শাফেয়ি অধ্যয়ন করেন। এ সময় তিনি ফিকহে হানাফিও অধ্যয়ন করেন; অপরাপর ফিকহের সঙ্গে পরিচিত হন। কিন্তু একটি সীমাবদ্ধ মাজহাবের গণ্ডিতে ‘বন্দিজীবন’ ইবনের হাজমের মতো মুজতাহিদ ইমামের জন্য অসহ্যকর ছিল বিধায় তিনি শাফেয়ি মাজহাবেও বেশি দিন স্থির থাকতে পারেননি। জাহেরি মাজহাবের দাঈর ভূমিকায় অতঃপর তিনি ইমাম শাফেয়ি রহ.-এর ছাত্র ইমাম দাউদ জাহেরি বাগদাদি আসবাহানি রহ.-এর চিন্তাধারায় আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। এরপর কুরআন ও হাদীসের জাহেরি বা বাহ্যিক দিকের অনুসরণের প্রতি লোকদের আহ্বান করতে থাকেন। এরপর তিনি এ মাজহাবকে খুব সমৃদ্ধ করে তোলেন।