বার্ট্রান্ড রাসেল যে ইতিহাস নিয়ে খুব বড় ধরনের কাজ করেছেন তেমন বলা যায় না; কিন্তু গোটা চারেক ছোটো প্রবন্ধ এবং পুস্তিকাসম দীর্ঘ একটি রচনা তাঁর ইতিহাসবিষয়ক চিন্তার মূল প্রত্যয় হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। আমরা সেই রচনাগুলোকে একত্রে গ্রথিত এবং অনুবাদ করে এই পুস্তকে সন্নিবেশিত করেছি। ‘On History’ প্রবন্ধটিতে তিনি লিখেছেন, ‘আমাদের ব্যক্তিগত স্মৃতি যেস্থল থেকে যাত্রা শুরু করে সেই স্থলে পৃথিবী কীভাবে উন্নীত হয়েছে; কীভাবে ধর্ম, প্রতিষ্ঠানাদি এবং যে-জাতিতে আমাদের বাস, তা বর্তমান রূপ লাভ করেছে; অন্য কালের মহান সব জিনিসের সঙ্গে, আমাদের কাছ থেকে ভিন্ন আচারপ্রথা ও বিশ্বাসের সঙ্গে পরিচিত হওয়া, এসব জিনিসে আমাদের অবস্থান সম্পর্কিত যে কোনও চেতনা অর্জনের জন্য এবং আমাদের শিক্ষার দুর্ঘটনাময় পরিস্থিতি থেকে মুক্তিলাভের জন্য (ইতিহাস পাঠ ও জানা) অপরিহার্য।' এ কথাগুলোই বার্ট্রান্ড রাসেলের ইতিহাস সম্পর্কিত ধারণা এবং তা পাঠের উদ্দেশ্য হিসেবে আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। তিনি ইতিহাসতত্ত্বের বিভিন্ন প্রখ্যাত প্রণোগণকেও এই ক'টি লেখার মাধ্যমে নাকচ করার উদ্যোগ নিয়েছেন । যেমন ইতিহাসের ভাববাদী এবং বস্তুবাদী দ্বান্দ্বিক অগ্রগতি, ইতিহাসের চক্রাকার অগ্রগতি, ইত্যাদিকে তিনি বাস্তব আলোকে প্রমাণযোগ্য নয় বলে বলেছেন। ইতিহাসের যে কোনও নির্ধারিত গতিপথ নেই, প্যারাডাইম নেই, কোনও ছন্দ বা প্যাটার্ন নেই, কোনও বিশেষ কার্য-কারণ সূত্রে যে ইতিহাস ব্যাখ্যাযোগ্য নয়, তা যে উন্মুক্ত গতিময় এক ধারা, অনেকক্ষেত্রে কবিতার মতো, আনন্দপাঠের জন্য রচিত এক সাহিত্য — তেমন কথা বলেন রাসেল এই সংকলনটির রচনাসমূহে । এই সংকলনটি হয়ত ইতিহাস সম্পর্কিত অনেক মিথকে নাকচ করার ক্ষেত্রেও সহায়ক বলে প্রতিভাত হতে পারে ।
(১৮ মে ১৮৭২ – ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭০) ছিলেন একজন ব্রিটিশ দার্শনিক, যুক্তিবিদ, গণিতবিদ, ইতিহাসবেত্তা, সমাজকর্মী, অহিংসাবাদী, এবং সমাজ সমালোচক.যদিও তিনি ইংল্যান্ডেই জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন, তার জন্ম হয়েছিল ওয়েলস এ, এবং সেখানেই তিনি ৯৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। রাসেল ১৯০০ সালের শুরুতে ব্রিটিশদের আদর্শবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে নেতৃত্ব প্রদান করেন। তাকে বিশ্লেষণী দর্শনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বিবেচনা করা হয়, এর অন্যান্য প্রতিষ্ঠাতারা ছিলেন তার শিষ্য ভিটগেনস্টেইন এবং পূর্বসূরি ফ্রেগে এবং তাকে ২০ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম যুক্তিবিদদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। রাসেল এবং হোয়াইটহেড একত্রে প্রিন্কিপিয়া ম্যাথমেটিকা নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন, যাতে তারা গণিতকে যুক্তির ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন। তার দার্শনিক নিবন্ধ "অন ডিনোটিং" দর্শনশাস্ত্রে মডেল হিসেবে বিবেচিত হয়। দুটো গ্রন্থই যুক্তি, গণিত, সেট তত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব এবং দর্শনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। তিনি ছিলেন একজন প্রখ্যাত যুদ্ধবিরোধী ব্যক্তিত্ব এবং জাতিসমূহের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্যে বিশ্বাস করতেন। তিনি ছিলেন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী। রাসেল তার অহিংস মতবাদ প্রচারের জন্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জেলবন্দী হন, তিনি হিটলারের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালান, সোভিয়েত টোটালিটারিয়ানিজম এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার অংশগ্রহণের সমালোচনা করেন এবং পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের পক্ষে ছিলেন সর্বদা সোচ্চার। রাসেল ১৯৫০ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন, যা ছিল "তার বহুবিধ গুরুত্বপূর্ণ রচনার স্বীকৃতিস্বরূপ যেখানে তিনি মানবতার আদর্শ ও চিন্তার মুক্তিকে ওপরে তুলে ধরেছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধবিরোধীর ভূমিকা নেন, ফলস্বরূপ তাঁকে ছ'মাস কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়। সেই সঙ্গে কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজের অধ্যাপক পদ থেকে বরখাস্ত হন। ১৯৫০ সালে পারমানবিক নিরস্ত্রীকরণের পক্ষে আন্দোলন সংগঠিত করার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এই কারণে ১৯৬১ সালে তাঁকে আবার কারাদনণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। ১৯৭০ সালে বারট্রান্ড রাসেল মৃত্যুবরণ করেন।