ভূমিকা প্রায় পঁচিশ বছর ধরে বাগদেবীর পেছনে পেছেনে ছুটে চলেছি। কখনো তিনি আমাকে নিয়ে যান স্নিগ্ধ উপতক্যায় ,প্রাচীন উদ্যানে, ঝরনাতলায় ,সূর্যোদয়ে ঝলমলে টিলায়, কখনো বা তাকে অনুসরণ করতে গিয়ে পৌঁছে যাই চোরাবালিতে। প্রায়শই ব্যর্থতার কুশে পা ক্ষত-বিক্ষত হয়, মাঝে মাঝে অবসাদ আমাকে লক্ষ্য করে ,যেমন কোনো শবভুক পাখি চক্রাকারে ওড়ে মৃতকল্প পথচারীর ওপর।কিন্তু আমি কখনো হাল ছাড়িনি।কোনো একদিন প্রকৃত সিদ্ধির সন্ধান মিলবে। এই আশায় এখনো যাত্রা অব্যাহত রেখেছি। শেষ পর্যন্ত পণ্ডশ্রম হবে কিনা, জানি না। গন্তব্যে পৌঁছতে পারি আর নাই পারি, আমার পথ চলাতেই আনন্দ। কবিতার লেখার সময় ,কোনো এক রহস্যময় কারণে , আমি শুনতে পাই চাবুকের তুখোড় শব্দ। কোনো নারি আর্তনাদ, একটি মোরগের দৃপ্ত ভঙ্গিমা, কিছু পেয়ারা গাছ , বাগান ঘেরা একতলা বাড়ি, একটি মুখচ্ছবি, তুঁত গাছের ডালের কম্পন,ধিকিয়ে চলা ঘোড়ার গাড়ি, ঘুমন্ত সহিস ভেসে ওঠে দৃষ্টিপথে বারবার। কিছুতেই আগুলো দূরে সরিয়ে দিতে পানি না। যা কিছ মানুষের প্রিয়-অপ্রিয়, যা কিছু জড়িত মানব নিয়তির সঙ্গে, সেসব কিছুই আকর্ষণ করে আমাকে। সবচেয়ে বড় কথা, সুদূর সৌরলোক,এই সরাচর মানুষের মুখ,বাঁচার আনন্দ কিংবা যন্ত্রণা, সবসময় বন্দনীয় মনে হয় আমার কাছে। এসবের বন্দনা-ই কি আমার কবিতা? বলা মুশকিল; কবিতা বড় গূঢ়াশ্রয়ী, বড়গ জটিল। আমি তো জীবনের স্তরে স্তরে প্রবেশ করতে চাই, কুড়িয়ে আনতে চাই পাতালের কালি, তার সকল রহস্যময়তা। যে মানুষ টানেলের বাসিন্দা, যে মানুষ দু:খিত, একাকী, সে যেমন আমার সহচর, তেমনি আমি হাঁটি সেসব মানুষেল ভিড়ে, যারা ভবিষ্যতের দিকে মুখ রেখে তৈরি করে মিছিল। যা হোক, এ যাবৎ আমি এগারোটি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছি। এই বইগুলোর সাফল্য কিংবা সার্থকতা বিষয়ে আমি আদৌ চিন্তিত নেই। আসলে, একটি বই লেখা হয়ে যাওয়ার পর সেটি আমাকে বেশি দিন ধরে রাখতে পারে না। আমি বিছিন্ন হয়ে যাই সেই গ্রন্থ থেকে, কেমন নৃষ্পহা হয়ে পড়ি। কবিতা বাছাইয়ের ব্যাপারে তেমন কোনো পরিকল্পনার বশীভূত হই নি, তবে বিষয় -বৈচিত্র্যের দিকে নজর রাখতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। এজন্য এমন কিছু কবিতাও বাদ দিতে হয়েছে,যেগুলো এই গ্রন্থে সঙ্কলিত হলে আমি খুশি হতাম। যেহেতু প্রত্যেক বইয়ের একটি নির্দিষ্ট ধারণ ক্ষমতা থাকে; তাই ইচ্ছা থাকলেওেএই সঙ্কলনে নির্বাচিত সব কবিতাকে ঠাঁই দেয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। এ কারনেই বাদ পড়েছে অনুবাদ কবিতা এবং শিশুতোষ রচনা। কবিতা বাছাই করতে গিয়ে যদিও আমি নিজের পছন্দকেই বেশি প্রশ্রয় দিয়েছি, তবু এ ব্যাপারে আবুল হোসেন ,রশীদ করীম,জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী এবং কায়সুল হকের বিশেষজ্ঞ পরামর্শ গ্রহণ করেছি কৃতজ্ঞতা চিত্তে । কবিতা নির্বাচনের সময় এমন কিছুসংখ্যক পাঠকের পছন্দ-অপছন্দের কথাও মনে রেখেছি, যাঁরা আমাকে বারংবার প্রশংস ও নিন্দায় ধন্য করেছেন। -শামসুর রহমান সেপ্টেম্বর,১৯৭৬
সূচিপত্র * প্রথম গান ,দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে( ১৯৬০) * রৌদ্র করোটিতে( ১৯৬৩) * বিধ্বস্ত নীলিমা (১৯৬৭) * নিরালোকে দিব্যরত (১৯৬৮) * নিজ বাসভূমে (১৯৭০) * বন্দী শিবির থেকে (১৯৭২) * দু:সময়ে মুখোমুখি (১৯৭৩) * ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা (১৯৭৪) * আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি (১৯৭৪) * এক ধরনের অহংকার (১৯৭৫) * আমি অনাহারী (১৯৭৬) * শূন্যতায় তুমি শোকসভা (১৯৭৭) * বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে (১৯৭৭) * প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে (১৯৭৮) * ইকারুসের আকাশ (১৯৮২) * মাতাল ঋত্বিক (১৯৮২) * উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ (১৯৮২) * কবিতার সঙ্গে গেরস্তালি(১৯৮৩) * নায়কের ছায়া (১৯৮৩) * আমার কোনো তাড়া নেই (১৯৮৪) * যে অন্ধ সুন্দরী কাঁন্দে (১৯৮৪) * অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই (১৯৮৫) * শিরোনাম মনে পড়ে না (১৯৮৫) * ইচ্ছে হয় একটু দাঁড়াই * হোমারের স্বপ্নময় হাত (১৯৮৫) * ধুলায় গড়া শিরস্ত্রাণ (১৯৮৫) * এক ফোঁটা কেমন অনল (১৯৮৬) * দেশদ্রোহিী হতে ইচ্ছে করে (১৯৮৬) * অবিরাম জলভূমি (১৯৮৬) * আমার ক’জন সঙ্গী (১৯৮৬) * টেবিলের আপেলগুলো হেসে ওঠে( ১৯৮৬) * ঝর্ণা আমার আঙ্গুলে (১৯৮৭০ * স্বপ্নেরা ডুকরে ওঠে বারবার(১৯৮৭) * খুব বেশি ভাল থাকতে নেই (১৯৮৭) * বুক তার বাংলাদেশের হৃদয় (১৯৮৮) * মঞ্চের মাঝখানে (১৯৮৮) * হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো(১৯৮৯) * ধ্বংসের কিনারে ব’সে(১৯৮৯) * গৃহযুদ্ধের আগে(১৯৯০) * সে এক পরবাসে(১৯৯০) * খণ্ডিত গৌরব (১৯৯২) * হরিণের হাড় (১৯৯৩) * আকাশ আসবে নেমে (১৯৯৪) * এসো কোকিল এসো স্বর্ণচাঁপা (১৯৯৫) * উজাড় বাগানে (১৯৯৫) * মানব হৃদযে নৈবেদ্য সাজাই (১৯৯৬) * তুমি নি:শ্বাস তুমি হৃদস্মন্দন (১৯৯৬) * হেমন্ত সন্ধ্যায় কিছুক্ষণ( ১৯৯৭) * ছায়াগনের সঙ্গে কিছুক্ষণ (১৯৯৭) * তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি( ১৯৯৭) * সৌন্দর্য আমার ঘরে(১৯৯৮) * মেঘলোকে মনোজ নিবাস(১৯৯৮) * রূপের প্রবালে দগ্ধ সন্ধ্যারাতে(১৯৯৯) * টুকরো কিছু সংলাপের সাঁকো (১৯৯৯) * স্বপ্ন ও দু:স্বপ্নে বেঁচে আছি(২০০০) * নক্ষত্র বাজাতে বাজাতে(২০০০) * হৃৎপদ্মে জ্যোস্না দোলে(২০০১) * শুনি হৃদয়ের ধ্বনি(২০০১) * ভস্মস্তুপের গোলাপের হাসি (২০০২) * ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুঁকেছে (২০০৩) * কৃষ্ণপক্ষে পূর্ণিমার দিকে(২০০৪) * গন্তব্য নাই বা থাকুক(২০০৪) * গোরস্তানে কোকিলের করুণ আহ্বান (২০০৫) * না বাস্তব না দু:স্বপ্ন (২০০৬) * অন্ধকার থেকে আলোয়( ২০০৬) * শামসুর রহমানের অগ্রন্থিত কবিতা (২০০৭)
নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানা থেকে আরেকটু ভেতরে মেঘনাপাড়ের গ্রাম পাড়াতলী। কবি শামসুর রাহমানের পৈতৃক নিবাস। তবে জন্মেছিলেন ঢাকা শহরের ৪৬ নম্বর মাহুতটুলির বাড়িতে। তারিখ ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর। দশ ভাইবোনের মধ্যে জেষ্ঠ্য তিনি। ১৯৪৮ সালে যখন তার বয়স মাত্র ১৯ বছর তখন মননের গহীন তল্লাটে কবিতার যে আবাদভূমি গড়ে উঠেছিল, তা কেবল উর্বরই হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে নলিনী।কিশোর গুহের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় প্রথম কবিতা। তারপর দে ছুট। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পেয়েছেন আদমজী পুরস্কার (১৯৬৩), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৯), একুশে পদক (১৯৭৭), সাংবাদিকতার জন্যে পেয়েছেন জাপানের মিৎসুবিশি পদক (১৯৯২), ভারতের আনন্দ পুরস্কার (১৯৯৪) ছাড়াও বহু পুরস্কার। ডিলিট উপাধিতেও ভূষিত হয়েছেন। ‘মর্নিং নিউজ’-এ সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে ১৯৫৭ সালে যে চাকরি জীবন শুরু করেছিলেন, একই পেশায় থেকে ১৯৮৭ সালে দৈনিক বাংলার সম্পাদক পদ থেকে তিনি চাকরিতে ইস্তফা দিয়েছেন, তবু খেই হারাননি জীবন, সাহিত্য ও কবিতার পাঠ থেকে। মূলত কবি হলেও সাহিত্যে তাঁর কাজ বহুমাত্রিক। অনুবাদ সাহিত্য থেকে গদ্যের বিভিন্ন প্রশাখায় বিচরণ করেছেন তিনি। ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট ৭৬ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।