ইসলামদ্রোহী এবং ইসলামের পক্ষে ক্ষতিকর প্রতিটি প্রচেষ্টা ও অভিযানের প্রতি সবসময়ই ছিল শায়খুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানী রাহিমাহুল্লাহর সতর্কদৃষ্টি। এরূপ প্রতিটি ফিতনার প্রতিরোধ ও বিরুদ্ধে ছিল তাঁর অক্লান্ত জিহাদ, নির্ভীক সংগ্রাম। তাই ইসলামের ইতিহাসের এই জঘন্যতম এবং অন্যতম ফিতনা মওদূদিয়ত তথা জামাতে ইসলামীর যখন উদ্ভব হয় এবং মুসলমান সমাজে ক্রমশঃ তা অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং নিপুণ কৌশলে বিষ ছড়াতে থাকে, তখন এ বিষয়ে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করতঃ মওদূদী ও জামাতে ইসলামীর প্রচারপত্র এবং প্রচেষ্টার নিদর্শন পেশ হতে থাকে তাঁর সম্মুখে। তখন সর্বপ্রথমে তিনিই এর প্রতিরোধে সক্রিয় পদক্ষেপ রাখেন, যদিও তাঁর দূরদর্শী এবং অন্তর্দৃষ্টি শুরুতেই এর ভয়াবহ পরিণাম এবং ইসলাম ও মুসলমানের পক্ষে এর মারাত্মকতা দেখতে পায়, উপলব্ধি করতে পারে; তবুও কিন্তু তিনি সরাসরি মওদূদী এবং জামাতে ইসলামীর কিতাবপত্র এবং প্রচার সাহিত্য তখনও ভাল করে পড়ে দেখতে পারেন নি। তাঁর অনন্য সাধারণ কর্মব্যস্ততার মধ্যে তা সম্ভবও ছিলনা; অথচ আসল কিতাবপত্র স্বচক্ষে না দেখে শুধুমাত্র পাঠকমহল প্রেরিত কাটিং এবং সংক্ষিপ্ত নোটের ভিত্তিতে কারও সম্বন্ধে কোন নিশ্চিত সিদ্ধান্ত ও মন্তব্য প্রকাশ ছিল তাঁর স্বভাব বিরুদ্ধ। তাই ১৩৭০ হিজরী মোতাবিক ১৯৫০-৫১ খ্রিস্টাব্দে একদা তিনি যুগপ্রসিদ্ধ মণীষী, হাদীস শাস্ত্রবিদ, মাযাহিরুল উলূম সাহারানপুরের মহাপুরুষ এবং শায়খুল হাদীস মাওলানা যাকারিয়া রহমাতুল্লাহি আলাইহির সাথে তাঁরই বাড়িতে দেখা করতে যান। সেখানে যুগপ্রসিদ্ধ বুযুর্গ হযরত শায়খ আবদুল কাদির রায়পুরী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির উপস্থিতিতে রুদ্ধদ্বার নিভৃতকক্ষে তাঁদের দুই জনের সম্মুখে মওদূদী ফিতনা এবং জামাতে ইসলামী সম্পর্কে উত্থাপন করতঃ বলেন- আমার কাছে অনবরত মওদূদী ফিতনা এবং জামাতে ইসলামী সম্পর্কে চিঠিপত্র আসছে। (জামাতে ইসলামীর তদানীন্তন সর্বভারতীয় আমীর) মাওলানা আবুল্লেইসও বারে বারে আমার সাথে আলোচনা করতে চাচ্ছেন; অথচ আমি এ বিষয়ে তাদের কিতাবপত্র পড়ে দেখবার অবসরও পাচ্ছি না, কোন স্থির সিদ্ধান্তও ঘোষণা করতে পারছি না; এ বিষয়ে আপনাদের অভিমত কি? তদুত্তরে হযরত শায়খুল হাদীস যাকারিয়া রাহ. হযরত শায়খুল ইসলাম এবং হযরত রায়পুরীকে সম্বোধন করে বলেন— আপনাদের জুতা আমার মাথায় রাখতে পারি; আপনাদের পাদুকা আমার শিরোধার্য; এতদসত্ত্বেও যদি মওদূদী এবং জামাতে ইসলামীকে সমর্থন করতে বলেন, তবে আমি তা পারব না। আমি মাযাহিরের অধ্যক্ষ সাহেবের পীড়াপীড়িতে গত ১৩৭০ হিজরীর জুমাদাল উলা হতে শাবান পর্যন্ত চার মাস আমার অন্যান্য কাজকর্ম এবং পড়াশুনা বাদ দিয়ে শুধু মওদূদী এবং জামাতে ইসলামীর সভ্যদের লিখিত প্রায় এক হাজার কিতাবপত্র পড়েছি; জামাতে ইসলামীর ভক্ত ছাত্র এবং অন্যান্যরাই এ সমস্ত কিতাবপত্র উৎসাহ ভরে আমাকে সরবরাহ করেছিল। বলাবাহুল্য আমি যতই ঐ কিতাবপত্রগুলি পড়তে থাকি, ততই তাদের প্রতি আমার ঘৃণা এবং বিদ্বেষ বাড়তে থাকে। আমি দেখতে পাই কমিউনিজম প্রভৃতির বিরুদ্ধে তো মওদূদীর লেখনি তেমন জোরালো নয়, ভাসাভাসা চলে; কিন্তু হাদীসশাস্ত্র এবং দ্বীন ইসলামের বিরুদ্ধে চলে বল্গাহারা অশ্বের মত। তার লেখনীতে তীব্র আক্রোশ ঝরতে থাকে; তার অনবরত নিক্ষিপ্ত সমালোচনার তীর শুধু ফেকাহশাস্ত্রবিদ, আউলিয়া-বুযুর্গানই নয়, পুণ্যাত্মা সাহাবাবৃন্দ এমনকি স্বয়ং হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকেও নির্মমভাবে বিদ্ধ করেছে। মুহাদ্দিস, মুফাসসির, সূফী-দরবেশ, সাহাবায়ে কেরাম এবং পয়গম্বর কেউই রেহাই পান নি তার আক্রমণ থেকে। মওদূদী সাহেব যে বিষয়ের প্রতিবাদ করতে চান তাকে “লোকের অলীক ধারণা” বলে এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে যান। জুমার মাসআলা এবং ইমাম মাহদী আ. সংক্রান্ত আলোচনায় আমি উল্লেখ করেছি যে— মওদূদী সাহেব স্বয়ং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উক্তিকেও মানুষের মনগড়া ধারণা এবং কপোলকল্পিত বলে অভিহিত করেছেন; অথচ আমাদের বুদ্ধিতে আসুক আর নাই আসুক, হুযুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উক্তিকে নির্বিচারে অম্লান বদনে মেনে নেওয়াতেই আমরা আমাদের মুক্তি এবং নাজাত বলে বিশ্বাস করি। এমতাবস্থায় মওদূদী সাহেব যখন স্বয়ং হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের “ইরশাদ”কেও মানুষের মনগড়া ধারণা ও উক্তি বলে উল্লেখ করেন, তখন হাদীস শাস্ত্রের প্রাথমিক পাঠকও তাতে বিদ্বিষ্ট উত্তেজিত না হয়ে পারে না। এতদসংক্রান্ত যে সমস্ত বিষয় আমি তাদের কিতাবপত্র হতে নোট করে রেখেছি, শুধুমাত্র তা পড়ে দেখতে গেলেও যথেষ্ট সময় এবং ধৈর্য্য চাই। এতে হযরত শায়খুল ইসলাম মদনী রাহ. বলেন— আজ তো সময় হবে না, আমি দুই তিন দিন পরে মাওলানা ইযায আলী (দারুল উলুম দেওবন্দের তদানীন্তন মুফতী এবং শায়খুল আদব) কে সঙ্গে নিয়ে আসছি; তুমি তোমার উল্লিখিত সমস্ত নোট এবং যা হতে এ সমস্ত উদ্ধৃতি নোট করেছ তথা মওদূদী ও জামাতে ইসলামীর সে সমস্ত আসল কিতাবও প্রস্তুত রাখ। সমস্ত কিছু তখন দেখব- এই বলে তিনি দেওবন্দে রওয়ানা হয়ে যান এবং সত্য সত্যই দু তিন দিন পর হযরত মওলানা ইযায আলী রাহমাতুল্লাহি আলাইহিকে সঙ্গে করে এখানে উপস্থিত হন। দুই দিন অবস্থান করতঃ রুদ্ধদ্বার কক্ষে শায়খুল হাদীস যাকারিয়া সাহেবের উদ্ধৃতি জামাতে ইসলামী এবং মওদূদীর লিখিত কিতাবাদী হযরত শায়খ যাকারিয়া, মাওলানা ইযায আলী এবং মুফতী সায়ীদ আহমদ রাহ. (মাযাহিরুল উলুমের তদানীন্তন মুফতী) সমভিব্যাহারে তন্ন তন্ন করে ঘাটাঘাটি করেন এবং ইসলামের বিগত চৌদ্দশত বৎসরের ইতিহাসে খারিজী, রাফিযী, কাদিয়ানী প্রভৃতির মত মওদূদিয়ত তথা জামাতে ইসলামীও অন্যতম ফিতনা বলে স্থির সিদ্ধান্ত নিয়ে দেওবন্দে চলে যান এবং এই জঘন্যতম ফিতনার বিরুদ্ধে তীব্রভাবে প্রচার অভিযান চালাতে থাকেন। এ বিষয়ে তাঁর ভক্ত-শিষ্যদের কাছে লিখিত পত্রাবলীর মাধ্যমে মওদূদিয়তের ভয়াবহতা তোলে ধরেন। বক্ষ্যমাণ অনূদিত গ্রন্থটি তাঁর সেই পত্রাবলীর বাংলা সংকলন।