"বাঙালি নারী: সাহিত্যে ও সমাজে" বইটির মুখবন্ধ থেকে নেয়াঃ প্রায় ২৪০০ বছর এবং যােজন যােজন ব্যবধানের দুই সাহিত্যস্রষ্টার সৃষ্ট দুই চরিত্রের কথা উদ্ধৃত করা হয়েছে ওপরে। নারী সম্পর্কে কতই না উক্তি করা হয়েছে এতকাল ধরে। নারী একই সঙ্গে প্রকৃতির ফুল ও ভুল; বিধাতার দ্বিতীয় ভ্রান্তি; শুধু বিধাতার সৃষ্টি নয়, আপন অন্তরের সৌন্দর্য দিয়ে পুরুষের গড়া। নারী প্রতিযােগিতাপ্রিয়, প্রতিশােধপরায়ণ, ধ্বংসাত্মক; প্রেরণা দেয় বটে, সর্বনাশও ডেকে আনে, তাই সে হলাে নরকের দ্বার। সে সজ্জাপ্রিয়, সম্পদানুরাগী, বিস্মৃতিপরায়ণ। অবলা নারী কথা বলে বিস্তর, তাও অনর্থক। সে অপ্রিয়বাদিনী, ছলনাময়ী, দুর্বলচিত্ত। রহস্যময়ী—দুর্বলতাই তার শক্তি; দুর্বোধ্য—কেননা সে যা বলে তা বােঝায় না। তার রয়েছে হৃদয়বত্তা, প্রেমসর্বস্বতা; সে ভালােবাসে প্রবলভাবে, ঘৃণাও করে চরমভাবে। সে যুক্তি মানে না, বুদ্ধিপ্রয়ােগে কুণ্ঠিত, আবার নিজের রূপ ও বুদ্ধিমত্তার প্রশংসায় তুষ্ট। সে সৌন্দর্যের সার, তার চরণে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েই আনন্দ। তার মুখের একটা তিলের জন্যে সুন্দর সুন্দর শহর বিলিয়ে দেওয়া যায়। বলা বাহুল্য, এ সবই পুরুষের উক্তি। নারী যখন নিজের ভাবনা প্রকাশ করতে পেরেছে, তখন সে এঁকেছে ভিন্ন মূর্তি। ইতিহাসে নারীর আরাে এক পরিচয় আছে। মাতৃতান্ত্রিক সমাজে তার আধিপত্য ছিল, সমাজের অর্থনৈতিক জীবনে ছিল তার ভূমিকার প্রাধান্য। পিতৃতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরে নারীর নিয়ন্ত্রণ গেল পুরুষের হাতে—তার ভূমিকা অনেকখানি পালটে গেল। সংসার করা ও সন্তানপালন করার পাশাপাশি কোনাে এককালে নারীর অংশীদারিত্ব ছিল কৃষিকর্মে। তারপর যখন তার স্থান হলাে গৃহকোণে, তখন সে গড়ে তুললাে কুটির শিল্প। সেই শিল্পজাত দ্রব্যের চাহিদা কমে এলে সে ফিরে এসেছে কৃষিতে, কিন্তু এবারে সহায়কের ভূমিকায়। কলকারখানার বিকাশের সঙ্গে সে কাজ করেছে অল্প মজুরিতে। রক্ষিতা হয়ে থেকেছে, পতিতাবৃত্তি মেনে নিয়েছে। এর পাশাপাশি দেখছি আরেক শ্রেণীর নারী—জীবনধারণের জন্যে যাদের কোনাে বৃত্তি অবলম্বন করতে হয় নি। সংসারের কাজ, এমন কি সন্তানপালনও, তার কাছে যথেষ্ট সম্মানজনক মনে হয় নি—এসব কাজের ভার পড়েছে ভৃত্য বা দাসীর ওপরে। ফলে তারা ভােগ করেছে প্রচুর অবসর—এত প্রচুর যে তা নিয়ে। সে কী করবে, তা ভেবে পায় নি। এই অবসরে কেউ কেউ আত্মনিয়ােগ করেছে সৃষ্টিশীল কাজে : সাহিত্য-দর্শন, সংগীত-চিত্রকলা, ভাস্কর্য-স্থাপত্যে তার প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছে। ধীরে ধীরে সমাজ ও সংসারে নিজের অবস্থা উপলব্ধি করেছে, নারী—তখন সে মাথা উঁচু করে তুলতে চেয়েছে। সে দাবি করেছে নিজের অধিকার—পারিবারিক মর্যাদার, সামাজিক সম্মানের, ভােটের। সে চেয়েছে পুরুষের সমকক্ষতা-জীবিকা গ্রহণ করেছে পুরুষের মতােই, দাবি করেছে পুরুষের সমকক্ষতা। রাজনৈতিক আন্দোলনে যােগ দিয়েছে, কারাগারে গেছে, দেশ চালিয়েছে। ধরণীর এক কোণে এই বঙ্গদেশে নারীর ক্রমবিকাশের ইতিহাস আমাদের স্পষ্ট জানা নেই। পরবর্তী পৃষ্ঠাগুলিতে বাঙালি নারী সম্পর্কে কিছু প্রসঙ্গের অবতারণা করা হয়েছে, ঐতিহাসিক অনুসন্ধানের কাজটি করা হয় নি। তার বড়াে কারণ ব্যাখ্যা করতে পারি এই রচনার ইতিহাস দিয়ে।
আনিসুজ্জামান একাধারে একজন বরেণ্য শিক্ষাবিদ, লেখক, গবেষক, ভাষা সংগ্রামী, সংবিধানের অনুবাদক এবং ইমেরিটাস অধ্যাপক। এককথায় তিনি একজন জীবন্ত কিংবদন্তি। এই গুণীজন ১৯৩৭ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাটে এক উচ্চশিক্ষিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বর্ণাঢ্য শিক্ষাজীবন শুরু হয় কলকাতার পার্ক সার্কাস হাই স্কুল থেকে। কৈশোরে পরিবারসমেত বাংলাদেশে চলে আসলে খুলনা শহরের এক স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৫১ সালে ঢাকার প্রিয়নাথ হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ১৯৫৩ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন আনিসুজ্জামান। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। সেখানে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অর্জন করে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। স্নাতক জীবনে তিনি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এবং ড. মুনীর চৌধুরীর মতো কিংবদন্তি শিক্ষকদের, যাদের সান্নিধ্যে তিনি নিজেকে গড়ে তোলেন। ১৯৫৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি শুরু করেন এবং ১৯৬৫ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি অর্জন করেন। অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য বিভিন্ন সময়ে তিনি বেশ কিছু বৃত্তি লাভ করেন। কর্মজীবনে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি শরণার্থী শিক্ষকদের সংগঠন 'বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি'র সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন। এছাড়াও তিনি জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রকল্পে অংশ নেন এবং 'কমনওয়েলথ অ্যাকাডেমি স্টাফ ফেলো' হিসেবে লন্ডন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করেন। বর্তমানে তিনি শিল্প ও সাহিত্যকলার বিভিন্ন শাখায় জড়িত আছেন। আনিসুজ্জামান এর বই সমগ্রতে তার প্রখর চিন্তাশক্তি ও বিশ্লেষণী ক্ষমতার পরিচয় মেলে। আনিসুজ্জামানের বইগুলো বেশিরভাগই গবেষণা এবং প্রবন্ধধর্মী। আনিসুজ্জামানের প্রবন্ধ এবং গবেষণা গ্রন্থগুলো হচ্ছে ‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’, ‘আমার একাত্তর’, ’সোশ্যাল এস্পেক্টস অব এন্ডোজেনাস ইন্টেলেকচুয়াল ক্রিয়েটিভিটি’ ইত্যাদি। আনিসুজ্জামান এর বই সমূহ এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো 'সাহিত্যে ও সমাজে', 'কালচার এন্ড থট', 'নারীর কথা', 'আইন-শব্দকোষ' ইত্যাদি। তিনি অসংখ্য পদক-পুরস্কার এবং সম্মাননা লাভ করেছেন। সেসবের মধ্যে ১৯৭০ সালে প্রবন্ধ-গবেষণার জন্য ‘বাংলা অ্যাকাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’ এবং ১৯৮৫ সালে শিক্ষায় অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত ‘একুশে পদক’ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ২০০৫ সালে কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ‘ডি.লিট’ ডিগ্রি প্রদান করে। ২০১৪ সালে তিনি ভারত সরকার প্রদত্ত 'পদ্মভূষণ' পদক লাভ করেন।