ফ্র্যাপে লেখা কথা ‘বন্ধুবান্ধব’ এক অন্যজাতের রচনা। জীবনের শুরু থেকে এ পর্যন্ত লেখক ইমদাদুল হক মিলনের জীবনে যাঁরা যাঁরা বন্ধু হয়ে এসেছেন তাঁদের প্রত্যেকের কথা আছে এই বইতে। স্মৃতিকথার আঙ্গিকে লেখা বইটিতে যেমন আছে আমাদের সময়কার অতি বিখ্যাত সব মানুষের সঙ্গে ইমদাদুল হক মিলনের নাটকীয় ভাবে হওয়া বন্ধত্বের কথা তেমনি আছে পাঠকের অপরিচিত অনেক হৃদয়বান মানুষের কথা, যাঁদের বন্ধুত্বের স্পর্শে জীবন ধন্য হয়েছে ইমদাদুল হক মিলনের। ‘বন্ধুবান্ধব’ এক অর্থে ইমদাদুল হক মিলনের অন্য রকমের এক আত্মজীবনী, যে আত্মজীবনী উপন্যাসের জমজমাট কাহিনীকেও হার মানায় ।
ভূমিকা আমি সাধারণত বইয়ের ভূমিকা লিখি না। কিন্তু এই বইটির ছোট্ট একটা ভূমিকা লেখা উচিত। একটি ব্যাপার আমি নিজেকে খুবই ভাগ্যবান মনে করি। সে হচ্ছে আমার বন্ধভাগ্য। জীবনে এমন এমন বন্ধু পেয়েছি, যেসব বন্ধুর কারণে জীবনের এই এতটা পথ পেরিয়ে আসতে পেরেছি। জীবনের যেক্ষেত্রে আটকে গেছি, বন্ধুরা আমাকে হাত ধরে পার করে এনেছে। আমার এই বই সেইসব বন্ধুকে নিয়ে লেখা। এই বইয়ের বাইরেও রয়ে গেছে অনেক মধুময় ঘটনা। সেইসব বন্ধুর কথা পর্যায়ক্রমে লিখবো। এই বই লিখতে গিয়ে বন্ধুদের কত রকমের সহযোগিতা যে পেয়েছি। আবদুর রহমান একদিন পুরনো দিনের কতগুলো ছবি দিল, শাইখ সিরাজ কতগুলো স্মৃতির কথা মনে করিয়ে দিল। সাগর আফজাল আরেফিন আলমগির দিদার সৌরভ পাভেল প্রত্যেকেই কোনও না কোনওভাবে সাহায্য করেছে। আর আমার অনুজপ্রতিম বন্ধু রেজানুর রহমান, ‘আনন্দ আলো’র সম্পাদক অতিযত্নে অতি মমতায় আমার ‘বন্ধুবান্ধব’ বছরের পর বছর ধরে ছেপে গেছে। একসংখ্যায় লেখা লিখতে দেরি হয়ে গেছে, রেজানুরের অফিসে গিয়ে বসেছি, এবার মাফ করে দাও । এই সংখ্যায় লিখতে পারবো না। রেজানুর বলল, আপনি বসেন মিলনভাই। দুপুরের খাবার আনাচ্ছি।লান্স করেন, চা খান। আমার টেবিল চেয়ার ছেড়ে দিলাম, এখানে বসে লিখুন। ‘বন্ধুবান্ধব’ ছাড়া ‘আনন্দ আলো’ বেরুবে না। আমি লিখতে বসে গেলাম। প্রিয় রেজানুর, ‘বন্ধুবান্ধব’ লেখার পেছনে তোমার অনুপ্রেরণার কথা কেমন করে ভুলি। সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অকৃতদার ফয়েজ আহ্মদ বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনের অধিকারী। রাজনৈতিকভাবে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারায় বিশ্বাসী। ১৯৪৮ সালে থেকে সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত। তিনি ইত্তেফাক, সংবাদ, আজাদ ও পরবর্তী সময়ে পূর্বদেশ-এ চিফ রিপোর্টার ছিলেন। সাপ্তাহিক ইনসাফ ও ইনসান পত্রিকায়া রিপোর্টিং করছেন। ১৯৫০ সালে কিশোর পত্রিকা হুল্লোড় সম্পাদনা করেন।১৯৭১ সালে স্বরাজ পত্রিকার সম্পদক ছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংবাদ সংস্থার(বিএসএস) প্রথম প্রধান সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবার্তা দৈনিকে প্রধান সম্পাদকরূপে কাজ করেন।১৯৫২সালে প্রতিষ্ঠিত মুক্তচিন্তা ও অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল লেখকদের সংগঠক পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ-এর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন দু’বছর। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি বছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন বছর সিন্ডিকেটের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন ৮০ ও ৯০-এর দশকে। ১৯৮২-এর দিকে বাংলা একাডেমীর কাউন্সিল সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু এরশাদের সামরিক শাসনের প্রতিবাদে অন্য ছয়জনের সঙ্গে তিনি পদত্যাগ করেন। ১৯৮৩ সারে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট-এর সভাপতি নির্বাচিত হন এবং তেরো বছর এ-পদে ছিলেন। জাতীয় কবিতা উৎসব-এর আহবায়ক ছিলেন।
১৯৫৫ সালের ৮ সেপ্টেম্বর বিক্রমপুরের মেদিনীমণ্ডল গ্রামে প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনের জন্ম। লেখনীশক্তির পাশাপাশি তার রয়েছে নাট্যরচনায় পারদর্শিতা। বর্তমানে বাংলাদেশের মূলধারার সংবাদপত্র ‘কালের কন্ঠ’-এর সম্পাদক পদেও নিয়োজিত রয়েছেন তিনি। শিশুতোষ গল্প দিয়ে সাহিত্য অঙ্গনে এ গুণী লেখকের প্রবেশ, যা প্রকাশিত হয়েছিলো ‘কিশোর বাংলা’ নামক এক পত্রিকায়। তবে পাঠকের নজরে পড়েছিলেন ‘সজনী’ নামের ছোট গল্প লিখে। খুব অল্প বয়সে তিনি লেখালেখিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। ফলে তার লেখার বিষয়বস্তুতে কোনো জটিল সমীকরণের দেখা মিলতো না, পাঠককে বিমল আনন্দ দেয়ার উদ্দেশ্যে প্রথমদিকে তিনি ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ বিষয়গুলোকে পরিহার করেছিলেন। তবে পরবর্তীতে ইমদাদুল হক মিলন এর বই সমূহ-তে মুক্তিযুদ্ধ, হাজাম সম্প্রদায়ের জীবন, প্রবাসী শ্রমিকদের দুঃখগাথা, পাটচাষী, গ্রাম বাংলার সমাজের এক নিখুঁত চিত্রও ফুটে উঠতে দেখা যায়। এ প্রসঙ্গে লেখকের বক্তব্য, তিনি নিজেই লেখার এরকম বিপরীতধর্মী দুটি ধরন আপন করে নিয়েছেন, আর এক্ষেত্রে তার অণুপ্রেরণা ছিলেন সমরেশ বসু। ইমদাদুল হক মিলন এর বই সমগ্র-তে স্থান পেয়েছে প্রায় দেড় শতাধিক নাটক এবং প্রায় দু’শো উপন্যাস। শিশুতোষ গল্প এবং ভৌতিক উপন্যাস রচনাতেও তার জুড়ি নেই। এই বৈচিত্র্যপূর্ণ সৃষ্টিশীলতার কারণে বাংলা উপন্যাস ইমদাদুল হক মিলন এর কাছে কৃতজ্ঞ। শুধু বাংলাদেশ না, পশ্চিমবঙ্গেও তার সমান জনপ্রিয়তা রয়েছে। দুই বাংলায় আলোড়ন সৃষ্টিকারী তার বহুল পঠিত উপন্যাস হলো ‘নূরজাহান’। এছাড়াও ইমদাদুল হক মিলন এর উপন্যাস সমগ্র বিভিন্ন পাঠকপ্রিয় উপন্যাসে ঠাসা। তাঁর কিছু উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হলো ‘জিন্দাবাহার’, ‘নিঝুম নিশিরাতে’, ‘যাবজ্জীবন’, ‘কালাকাল’, ‘কালো ঘোড়া’, ‘ভূমিপুত্র’, ‘পরাধীনতা’, ‘কে’, ‘তাহারা’, ‘ভূতের নাম রমাকান্ত কামার’ ইত্যাদি। দেশি-বিদেশি নানা সম্মানজনক পুরস্কারের পাশাপাশি ২০১৯ সালে তিনি একুশে পদক পান।