ফররুখ আহমদ আমাদের সাহিত্যের এক শক্তিমান কবি-ব্যক্তিত্ব। তাঁর সম্পর্কে আমাদের কাব্যামোদী পাঠকমহলের কৌতুহল যথেষ্ট। বাংলা কাব্যের ভাব ও ভাষায় তিনি যে বিপ্লব ঘটানোর প্রয়াস পেয়েছেন, তার একটা ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে। ত্রিশোত্তর কালের কবি হয়েও তিনি ত্রিশের কবিদের কাব্যভাবনার অনুবর্তন না করে, আধুনিক মুসলিম নব- জাগৃতির ঐতিহাসিক তাগিদে সাড়া দিয়ে স্বতন্ত্র ইস্লামী কৃষ্টির পরিপোষক এক নতুন কাব্যধারা প্রবর্তনে উদ্যোগী হয়েছেন। সমৃদ্ধ ইস্লামী ঐতিহ্যের যোগে সরস ও পরিপুষ্ট এ কাব্যধারা পূর্বপথিক বহু মুসলিম কবি ও সাহিত্যিকের অস্ফুট স্বপ্ন ও সাধকে অনেকটাই বাস্তবায়িত করতে সমর্থ হয়েছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু আমাদের মনে হয়, বিশেষ দেশ ও কালের সাথে প্রয়োজনীয় ঘনিষ্ঠ যোগের অভাবে তাঁর কাব্যের প্রাণসত্তা খুব বেশি স্ফূর্তি লাভ করতে পারেনি। উদ্ভিদমান জীবনকে পূর্ণমূল্য না দিয়ে ঐতিহ্যের স্বপ্নময় জগতে আপন কাব্যভাবনাকে নিবদ্ধ করে, কবি নিজের জ্ঞাতসারেই প্রায় নিজ কাব্যধারার অগ্রগতির পথ রুদ্ধ করেছেন। একজন শক্তিমান কবি-কর্মীর এ পরিণতি আমাদের কাছে মোটেই সুখকর বলে মনে হতে পারে না । বিশেষ শক্তিমত্তার অধিকারী শিল্পী হলেও, ফররুখের কবি-খ্যাতি তাই অনেকটাই রাহুগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। তথাপি শক্তিমান কবি হিসেবে ফররুখের মর্যাদা কখনই অস্বীকৃত হবে না। বাংলা কাব্যের তিনি এক সুদক্ষ রূপকার ও ভাষাশিল্পী । ভাবের ক্ষেত্রে তাঁর সীমাবদ্ধ যেমনই হোক, কাব্যের প্রকরণগত দিকে তাঁর শিল্পীসুলভ প্রযত্নের অভাব হয়নি কোন দিন। সুধীমহল তাই তাঁর কাব্য-ভাবনা-বৃত্তের সংকীর্ণতা দেখে ব্যথিত হলেও, তাঁর শিল্পকলা-কুশলতাকে অভিনন্দিত না করে পারেন নি। কাজী আবদুল ওদুদ, আবদুল কাদির, আবু রুশদ, মতিন উদ্দীন, মুজিবুর রহমান খান, দেওয়ান মুহম্মদ আজরফ, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, হাসান হাফিজুর রহমান, মোহাম্মদ মাহফুজ উল্লাহ্ প্রমুখ সুধীবৃন্দ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ফররুখ আর্মদের কবিকৃতি সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। বর্তমান লেখকও এক দশক পূর্বে সেরূপ চেষ্টা করেছিলেন। পুরাতন ‘মোহাম্মদী', 'সওগাত' ও অধুনালুপ্ত 'বিবর্তন' পত্রিকার পাতায় তার পরিচয় মিলবে। সে প্রয়াসকেই সুষ্ঠুতর এবং ব্যাপকতর ভিত্তি দানের উদ্দেশ্য নিয়ে এ-গ্রন্থটি রচিত হয়েছে। এ-কাজে কতটা সার্থক হয়েছি, তা বিচারের ভার সুধী সমাজের উপরই রইল । এ গ্রন্থ প্রকাশনার দায়িত্ব নিয়ে ‘নওরোজ কিতাববিস্তান' কর্তৃপক্ষ আমাকে কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করেছেন । বিশেষতঃ সুসাহিত্যিক জনাব মোহাম্মদ নাসির আলী সাহেব ব্যক্তিগত প্রযত্ন নিয়ে যে-ভাবে গ্রন্থটির সুষ্ঠু প্রকাশনার ব্যবস্থা করেছেন, তা এক প্রকার নজিরবিহীন। এ ছাড়া বহু উদারমনা সাহিত্যপ্রাণ ব্যক্তির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সাহায্যে এ-গ্রন্থ রচনায় যথেষ্ট সহায়ক হয়েছে, একথাও এখানেই বলে রাখছি। তবে তাঁদের কারও নাম ব্যক্তিগতভাবে উল্লেখ না করে এখানে সবাইর উদ্দেশ্যে আমার কৃতজ্ঞতা নিবেদন করছি।
অধ্যাপক ড. সুনীলকুমার মুখোপাধ্যায় ১৯২৯ সালের ১ মে, ফরিদপুর জেলার (বর্তমান শরীয়তপুর জেলা) দুলুখণ্ড গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৮ সালে মুন্সিগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজ থেকে আইএ পরীক্ষায় দশম স্থান অধিকার এবং ১৯৫০ সালে ডিগ্রি পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হন। ১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতকোত্তর পাশ করেন। কিছুকাল বিভিন্ন সরকারি কলেজে শিক্ষকতা করার পর ১৯৬৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগদান করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তিনি ১৯৭২ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগদান করেন। জীবদ্দশায় তিনি মোট নয়টি গ্রন্থ ও বহু প্রবন্ধ রচনা করেছেন। ধ্রুপদী কাব্যকলা ও সাহিত্য গবেষণা এবং অনুবাদ সাহিত্যে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন। জসীমউদদীন নামক গ্রন্থ প্রণয়নের জন্য তিনি ১৯৬৭ সালে 'দাউদ সাহিত্য পুরস্কার' এবং ২০০৩ সালে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক 'জসীমউদদীন গবেষণা পুরস্কার' (মরণোত্তর)-এ ভূষিত হন। অনুবাদ সাহিত্যে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখায় ১৯৮১ সালে তিনি 'বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার' লাভ করেন। একই বছর জসীমউদদীন: কবি মানস ও কাব্য সাধনা শীর্ষক গবেষণা সন্দর্ভের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এছাড়া তিনি ২০১০ সালে মরণোত্তর 'ফররুখ গবেষণা ফাউন্ডেশন পুরস্কার'-এ ভূষিত হন। তাঁর দুই কৃতী সন্তান অধ্যাপক তুহিন কুমার মুখোপাধ্যায় এবং অধ্যাপক ড. কাকলী মুখোপাধ্যায় শিক্ষকতার পাশাপাশি নিয়মিত সাহিত্যচর্চা করে চলেছেন। অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় ১৯৮৪ সালের ২৭ মে আকস্মিক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরলোকগমন করেন।