বুদ্ধদেব বসু বাংলা সাহিত্যে অবিস্মরণীয় নাম। আধুনিকতাবাদী ধারার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ও সমালোচক। বুদ্ধদেব বসুর কালজয়ী সৃষ্টি তপস্বী ও তরঙ্গিণী নাটক। ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে রচিত এই নাটক প্রকাশের শুরু থেকেই নানা কারণে আলোচনার ঝড় তুলেছে। পুরাণের অতিপরিচিত কাহিনিকে বুদ্ধদেব বসু নিজের মতো সাজিয়ে তাতে সঞ্চারিত করেছেন আধুনিক মানুষের মানসিকতা ও দ্বন্দ্ববেদনা। আশ্রমের মানুষকে দাঁড় করিয়েছেন সাধারণ মানুষের জীবনসংকটে। চারটি অঙ্কের স্বল্প পরিসরে কাব্যগুণে অনন্য এই নাটক। নাটকের কাহিনিতে দেখা যায়, অঙ্গদেশের রাজা লোমপাদ অভিশাপে জড়ে পরিণত হয়ে পড়েছিল। অঙ্গদেশে বৃষ্টিপাত বন্ধ। ফসলের মাঠ পুড়তে থাকে, রাজ্যে মহামারি মড়ক দেখা দেয় এবং নারীরা বন্ধ্যা হয়ে পড়ে। গণনায় জানা যায়, গঙ্গার ধারে নিবিড় বনের মধ্যে ঋষ্যশৃঙ্গ নামে এক তরুণ ঋষি সাধনায় মগ্ন। সে ছিল নারী-পুরুষ চেতনহীন। তপোবনের সেই ঋষি ঋষ্যশৃঙ্গের কৌমার্য ভঙ্গ করতে পারলেই তবে রাজ্যে বৃষ্টি হবে। রাজ্য আবার উর্বর হয়ে উঠবে, অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে। সে-পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্যের সবচেয়ে সুন্দরী, কলাবিদ্যায় পারদর্শী তরঙ্গিণী নামে এক বারবণিতাকে ঋষ্যশৃঙ্গের কৌমার্য ভাঙতে তপোবনে পাঠানো হয়। ঋষ্যশৃঙ্গ তখন সাধনায় নিবিষ্ট। ব্রহ্মচর্যে সে অনড়। ঋষ্যশৃঙ্গের পিতা বিভাণ্ডক পুত্রকে এমন নির্মমভাবেই মোক্ষের দিকে নিচ্ছেন। পিতা বিভাণ্ডক সর্বদা সচেতন ছিলেন – বিশ্বামিত্রের মতো যেন পুত্রের সাধনার স্খলন না ঘটে। অবশেষে তরঙ্গিণী কীভাবে ভক্তি, প্রেম, ছলনা ও শৃঙ্গারের সাধনা দিয়ে ঋষি ঋষ্যশৃঙ্গের কৌমার্য ভাঙে এবং রাজপ্রাসাদে নিয়ে আসে সে-কাহিনিই এগিয়ে চলে নাটকে। নানা দ্বন্দ্ব, নানা সংঘাত, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রনীতির স্বার্থপরতা কীভাবে মনুষ্যত্ববোধের বিপরীতে মানবিক হৃদয়ক্ষরণে জর্জরিত করে তোলে তার চিত্রই ফুটে উঠতে থাকে।
Buddhadeb Bosu- তিনি নভেম্বর ৩০, ১৯০৮ কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। একজন খ্যাতনামা বাঙালি সাহিত্যিক। তিনি একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, গল্পকার, অনুবাদক, সম্পাদক ও সাহিত্য-সমালোচক ছিলেন। ১৯২১ সালে ১৩ বছর বয়সে তিনি ঢাকায় আসেন এবং প্রায় দশ বৎসর ঢাকায় শিক্ষালাভ করেন। বুদ্ধদেব বসু ১৯২৩ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯২৫ সালে ঐ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রথম বিভাগে পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। ১৯২৭ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমানে ঢাকা কলেজ) থেকে প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে আই. এ. পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে থেকে ইংরেজিতে ১৯৩০-এ প্রথম শ্রেণীতে বি. এ. অনার্স এবং ১৯৩১-এ প্রথম শ্রেণীতে এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ছিলেন মেধাবী এক ছাত্র। বি. এ. অনার্স পরীক্ষায় তিনি যে নম্বর লাভ করেন তা একটি রেকর্ড; এবং অদ্যাবধি (২০০৯) এ রেকর্ড অক্ষুণ্ণ আছে। তাঁর পিতা ভূদেব বসু পেশায় ঢাকা বারের উকিল ছিলেন। তাঁর মাতার নাম বিনয়কুমারী। বুদ্ধদেব বসুর মাতামহ চিন্তাহরণ সিংহ ছিলেন পুলিশ অফিসার। তাঁর পৈতৃক আদি নিবাস ছিল বিক্রমপুরের মালখানগর গ্রামে। জন্মের চব্বিশ ঘণ্টা পরেই তাঁর মাতা বিনয়কুমারীর ১৬ বছর বয়সে ধনুষ্টঙ্কার রোগে মৃত্যু ঘটে। এতে শোকাভিভূত হয়ে তাঁর পিতা সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করে গৃহত্যাগ করেন। মাতামহ চিন্তাহরণ ও মাতামহী স্বর্ণলতা সিংহ'র কাছে প্রতিপালিত হন বুদ্ধদেব। বুদ্ধদেবের শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের প্রথমভাগ কেটেছে কুমিল্লা, নোয়াখালী আর ঢাকায়। অল্প বয়স থেকেই কবিতা রচনা করেছেন, ছেলে জুটিয়ে নাটকের দল তৈরি করেছেন। প্রগতি ও কল্লোল নামে দু'টি পত্রিকায় লেখার অভিজ্ঞতা সম্বল করে যে কয়েকজন তরুণ বাঙালি লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরজীবদ্দশাতেই রবীন্দ্রনাথের প্রভাবের বাইরে সরে দাঁড়াবার দুঃসাহস করেছিলেন তিনি তাঁদের অন্যতম। ইংরেজি ভাষায় কবিতা, গল্প, প্রবন্ধাদি রচনা করে তিনি ইংল্যান্ড ও আমেরিকায়ও প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। তিনি মার্চ ১৮, ১৯৭৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন।