খুনের বাণীটি পাই আমি স্বপ্নে। প্রথম আমি বিব্রত বোধ করি, ভয়ও পাই, যেন কেউ আমার ওপর এক অসম্ভব দায়িত্ব অর্পণ করেছে, আমাকে বাণী দিয়েছে, তার বাণী আমাকে পালন করতে হবে। আমি কি বাণী থেকে পালিয়ে যাব? কিন্তু আমার রক্ত প্রথম পালাতে চায়, তারপর পালাতে চায় না। অনেক রাত, রাতের পর রাত, স্বপ্নহীন থাকার পর- অন্তত স্বপ্নগুলো আমার মনে পড়েনি, ওগুলো হয়তো দ্রুত চলচ্চিত্রের মতো আমার মগজের পর্দায় ঝিলিক দিয়ে চলে গেছে-সেই আশ্চর্যজনক রাতে খুব এক আশ্চর্যজনক অপরূপ সুন্দর স্বপ্ন দেখেছিলাম বলে আবছা মনে পড়ে বা আমার মনে পড়ে না; স্বপ্নটি ভেঙে গেলে আমি খুন করার আবেগ বোধ করি, আমার মনে হয় স্বপ্নে আমি বাণী পেয়েছি। আমি তখন এসএম হলে থাকতাম, পুরভবনের দোতলার উত্তর দিকের কক্ষে; আমি আর চেয়ারে চোখ বুজে বসে থাকতে পারি না, সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় আসি, রেলিংয়ের ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে বাগানের ঝাউ আর পাতাবাহার গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে স্বপ্ন, খুন ও সিগারেটের ধোঁয়াকে জড়িয়ে ফেলি; ঠিক কাকে খুন করব, তা বুঝতে পারি না। স্বপ্নের বাণী সব সময়ই অস্পষ্ট বহু অর্থবোধক হয়, ঠিক মতো জানায় না কী করতে হবে; স্বপ্ন নিয়ে, অলৌকিক বাণী নিয়ে, এটাই চিরদিনের সমস্যা- একটা অর্থ বুঝতে গিয়ে আরেকটা অর্থ বুঝে ফেলে মানুষ; তবে আমার রক্ত ফিসফিস করতে থাকে, খুন করো, একটা খুন করো, নইলে তুমি বাঁচবে না। ১৯৬০-এর দশকের এক যুবকের প্রেমের মর্মান্তিক যন্ত্রণার অসামান্য উপন্যাস হুমায়ুন আজাদের একটি খুনের স্বপ্ন।
প্রচলিত ধ্যানধারণার বাইরে গিয়ে ব্যক্তিগত অভীষ্ট এবং রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিশ্বাস দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার মাধ্যমে ধর্ম, মৌলবাদ, প্রতিষ্ঠান ও সংস্কারের বিরুদ্ধে কলম তুলে নিয়ে বিশেষভাবে আলোচিত-সমালোচিত হয়েছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ। প্রথাবিরোধী এবং বহুমাত্রিক এই লেখক একাধারে ছিলেন কবি, ঔপন্যাসিক, সমালোচক, গবেষক, রাজনৈতিক ভাষ্যকার, ভাষাবিজ্ঞানী এবং অধ্যাপক। বাবা-মায়ের বড় সন্তান হুমায়ুন আজাদ ১৯৪৭ সালের ২৮ এপ্রিল মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর শৈশব ও কৈশোর কাটে রাঢ়িখাল গ্রামে, যার কথা পরবর্তীতে তাঁর বিভিন্ন সাহিত্যকর্মে উঠে এসেছে। ম্যাট্রিকুলেশন ও উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। এখান থেকেই তিনি বাংলা সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন এবং পরবর্তীতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। হুমায়ুন আজাদ এর বই সমূহ নারীবাদকে তুলে ধরেছে ও ধর্মীয় মৌলবাদের প্রবল বিরোধিতা করেছে, যার ফলে তিনি একশ্রেণীর মানুষের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছিলেন। হুমায়ুন আজাদ এর বই এর মধ্যে 'পাক সার জমিন সাদ বাদ', 'সব কিছু ভেঙে পড়ে', 'ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল' ইত্যাদি উপন্যাস ও 'অলৌকিক স্টিমার', 'জ্বলো চিতাবাঘ', 'কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু' ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ উল্লেখযোগ্য। হুমায়ুন আজাদ এর বই সমগ্র এর মধ্যে 'নারী' প্রবন্ধটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যা একসময় নিষিদ্ধ হয়েছিল এই দেশে। প্রতিভাবান এই সাহিত্যিক ২০০৪ সালের ১১ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি হিসেবে 'বাংলা একাডেমি পুরস্কার', 'একুশে পদক' সহ আরো অনেক পুরস্কারে ভূষিত হন হুমায়ুন আজাদ।