লুৎফর রহমান প্রকৃতই মানবপ্রেমিক লেখক। তিনি চোখের সম্মুখে দেখতে চেয়েছিলেন শুদ্ধ সমাজ, শুদ্ধ মানুষ, সুখি পরিবার। মানুষের ভ-ামি তিনি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করতে চেয়েছিলেন। লেবাসসর্বস্ব ধর্ম তিনি ঘৃণা করেছেন সর্বান্তকরণে। তার রচনাবলিতে পাওয়া যায় পরিচ্ছন্ন ধর্মবোধ, মানবিকতা, মানুষের রাজনীতি, সমসাময়িক অর্থনীতি, দৈনন্দিন কৃষিকর্ম, শরীরচর্চা, সুস্থ ও পরিমিত জৈবিক যৌনতা। এসব বিষয়ে লিখে তিনি আসলে একটি উন্নত, রুচিবোধসম্পন্ন জাতি তৈরি করতে চেয়েছিলেন। পরিমিতিবোধ, রুচিবোধ যে একজন সাধারণ মানুষকে উন্নত মানুষে পরিণত করতে পারে, এ কথা তিনি বলেছেন বারবার। ‘ধর্ম জীবন’ গ্রন্থে তিনি যেসব বিষয় আলোকপাত করেছেনÑ ঈমান ও ধর্ম বিশ্বাস, ধর্ম জীবন, ঈশ্বরের অপমান, ধর্মের ব্যাখ্যা, আজগুবী গল্প, ধর্মের জীবিত উৎস, ধর্ম কি চোখে দেখলাম, পাপ, মিথ্যা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, পবিত্র আত্মা, ঈশ্বরের রাজ্য বিস্তার, প্রভুর সংবাদ বহন, আল্লাহর আদেশ নর হত্যা করো না, আল্লাহর আদেশ মিথ্যা কহিও না, প্রতিবেশীকে প্রেম করিও, অন্ন দান ও দুঃখের উপশম চেষ্টা, প্রার্থনা, সম্মানিত ব্যক্তি ও প-িতদের সঙ্গের নিঃস্বার্থ সাক্ষাৎ, হাসপাতাল, পাপীর প্রতি ক্ষমাশীল, আত্মমর্যাদা জ্ঞান, ক্রোধ এবং অহংকার, প্রতিহিংসা ইত্যাদি।
মোহাম্মদ লুৎফর রহমান তৎকালীন ব্রিটিশ ভারত যশোর জেলার মাগুরা মহাকুমার (বর্তমান মাগুরা জেলা) পরনান্দুয়ালী গ্রামে ১৮৮৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার মাতা শামসুন নাহার এবং পিতা সরদার মইনউদ্দিন আহমদ, যিনি একজন স্টেশন মাস্টার ছিলেন। এই দম্পতীর চার পুত্র ও এক কন্যার মধ্যে মোহাম্মদ লুৎফর রহমান একজন। তার পৈত্রিক নিবাস ছিল তৎকালীন যশোর জেলার মাগুরা মহাকুমার হাজীপুর গ্রামে। লুত্ফর রহমানের পিতা ছিলেন এফ.এ পাস। ইংরেজি ভাষা ও ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি তার পিতার অনুরাগ ছিল। সম্ভবত একারণেই পিতার অনুরাগ লুৎফর রহমানের মাঝে প্রতিভাস হয়েছিল। নারী সমাজের উন্নতির জন্য নারীতীর্থ নামে একটি সেবা প্রতিষ্ঠান গঠন এবং নারীশক্তি নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন তিনি এবং একজন চিন্তাশীল ও যুক্তিবাদী প্রাবন্ধিক হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন। তার প্রবন্ধ সহজবোধ্য এবং ভাবগম্ভীর। মহান জীবনের লক্ষ্য সাহিত্যের মাধ্যমে মহান চিন্তাচেতনার প্রতি আকৃষ্ট হতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন তিনি। গভীর জীবনবোধ, মানবিক মূল্যবোধ, উচ্চ জীবন, সত্য জীবন, মানব জীবন, সূহ্ম বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গি তার রচনার প্রসাদগুণ। প্রবন্ধ ছাড়াও তিনি কবিতা, উপন্যাস ও শিশুতোষ সাহিত্য রচনা করেছেন। এফ.এ অধ্যয়নকালীন সময়ে লুৎফর রহমান তার নিজ গ্রাম হাজীপুরের 'আয়েশা খাতুন' নামে এক মহিলা সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। আয়শা খাতুনের পিতা মোহাম্মদ বদরউদ্দীন এ সময়ে মুন্সীগঞ্জ রেলওয়ের বুকিং ক্লার্ক ছিলেন। লুৎফর রহমানের সাহিত্য সাধনা শুরু হয়েছিল মূলত কবিতা রচনার মাধ্যমে। ১৯১৫ সালে চল্লিশটি কবিতা নিয়ে তার প্রথম এবং একমাত্র কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ প্রকাশিত হয়। পরে তিনি বিভিন্ন প্রবন্ধ, উপন্যাস, ছোটগল্প, কথিকা, শিশুতোষ সাহিত্য ইত্যাদি রচনা করেছেন। তার কিছু অনুবাদ কর্মও পাওয়া যায়। চরম দারিদ্রের মুখোমুখি যক্ষায় আক্রান্ত হয়ে মানবতাবাদী সাহিত্যিক ডাক্তার লুৎফর রহমান ১৯৩৬ সালের ৩১ মার্চ ৪৭ বৎসর বয়সে বিনা চিকিৎসায় নিজ গ্রাম মাগুরার হাজিপুর গ্রামে মৃত্যুবরন করেন