গণদেবতা কোনো বিশেষ ব্যক্তির ইতিবৃত্ত নয়। সমষ্টির সমগ্রতা নিয়েই তার সৌন্দর্য। জীবনের চলমান সমবায়ী বাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন তারাশঙ্কর তাঁর উপন্যাসে। এই বাস্তবতাকে তুলে আনার প্রয়োজনে তিনি শরণাপন্ন হয়েছেন নির্দিষ্ট দেশ, কাল ও ব্যক্তির। ব্যক্তি ছাড়া তো সমষ্টি অকল্পনীয়। অবান্তর সমাজ ভাবনা। ব্যক্তির মধ্যে সমষ্টির ব্যঞ্জনাকে ফুটিয়ে তোলার জন্যই গণদেবতা উপন্যাসে আমরা ব্যক্তি মানুষের বিস্তৃত পরিধি লক্ষ করি। পেশা, চিন্তা ও স্বভাবের বৈচিত্র্যে এই মানুষগুলো প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র সত্তার অধিকারী হলেও গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষ হিসেবে এরা শেষ পর্যন্ত একটি সম্মিলিত সুর মূর্ছনার সৃষ্টি করে, যে মূর্ছনাটি আবার কোনো ব্যক্তিবিশেষের চিন্তার প্রতিধ্বনি নয়, সমাজ চৈতন্যের। বাংলা দেশের এক সাধারণ গ্রামের অসাধারণ। কাহিনি গণদেবতা। কাহিনি জটিল নয়। বলা যায় এই সরলতা চেনা জীবনের প্রাত্যহিকতার মধ্য থেকেই উদ্ভাসিত। কিন্তু চেনা জীবনের পরিচিত মধুর সরলতাই মানুষের লোভ, লালসা, হিংসাবৃত্তি এবং অন্যকে ঠকানো ও অন্যের উপর শোষণমূলক অন্যায্য আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে জটিল ও বেদনাদায়ক হয়ে ওঠে। কাল প্রবাহে ভেসে চলা মানুষ তখন অস্তিত্বের অনিবার্য সঙ্কটে আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অভ্যস্ত পথ ছেড়ে ভিন্ন পথের সন্ধান করে। গণদেবতা উপন্যাসে অনিরুদ্ধ কামার, শ্রীহরি, দেবু ঘোষ, যতীন, পদ্ম, দুর্গা প্রমুখকে কেন্দ্র করে এমনটিই ঘটেছে কালের যাত্রায় গণমানুষের রথ কোথায় গিয়ে থামবে কারো জানা থাকলেও উপন্যাসে শ্রীহরি ঘোষের অনাচার-অত্যাচারের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য সংগ্রামের অগ্রসেনানী হিসেবে দেবু ঘোষ দ্রুত পদে অগ্রসর হয়ে যায়...
তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় বিংশ শতাব্দীর একজন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ছিলেন। ১৮৯৮ সালের ২৪ জুলাই ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলায় তাঁর জন্ম। তাঁর শৈশব কাটে এই বীরভূম জেলারই লাভপুর গ্রামে। ধর্মপরায়ণ ও আদর্শনিষ্ঠ বাবা-মায়ের কাছে তিনিও একই সততা ও আদর্শের শিক্ষা নিয়ে বেড়ে উঠতে থাকেন। লাভপুরের যাদবলাল হাই স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করে তিনি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। তবে নানা কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম শেষ করতে পারেননি। ভারতীয় স্বাধীনতা বিপ্লবের সময় রাজনৈতিক কারণে কারাভোগ করতে হয় তাঁর। মুক্তি পাওয়ার পর সাহিত্যে মনোনিবেশ করেন পুরোপুরি। তাঁর অনন্য প্রতিভায় জন্ম নিয়েছে একেকটি অসাধারণ পাঠকনন্দিত সাহিত্যকর্ম। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় রচনাবলী বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সমৃদ্ধ সম্পদ। তাঁর লেখা কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণীর মানুষের জীবনকে এককভাবে উপস্থাপন করে না, ফুটিয়ে তোলে গ্রামীণ ও নাগরিক জীবনের সব বৈশিষ্ট্যকে। সাহিত্য সৃষ্টি করতে তিনি বাদ রাখেননি কোনো শাখা। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস হলো ‘চৈতালি ঘূর্ণি (১৯৩২)’, ‘পাষাণপুরী (১৯৩৩)’, ’ধাত্রীদেবতা (১৯৩৯)’, ’কালিন্দী (১৯৪০)’, ’কবি (১৯৪৪)’, ’হাসুলী বাঁকের উপকথা (১৯৫১)’, ‘কালরাত্রি (১৯৭০)’ ইত্যাদি। তারাশঙ্করের উপন্যাস সমগ্র সংখ্যার হিসাবে প্রায় ৬৫টি। এর মধ্যে ‘কবি’ উপন্যাসটি তারাশঙ্করের কালজয়ী উপন্যাস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামার মাঝে তিনি বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠী ও সাহিত্য সম্মেলন এর নেতৃত্ব দান ও সভাপতিত্ব করেন। পশ্চিমবঙ্গের বিধান সভার নির্বাচিত সদস্য হিসেবে তিনি আট বছর দায়িত্ব পালন করেন। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় কবিতা সমগ্র হল ‘ত্রিপত্র (১৯২৬)। এছাড়াও সাহিত্য রচনা করেছেন ছোটগল্প, নাটক, প্রহসন ও প্রবন্ধ আকারেও। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের ছোটগল্প সংকলন হলো ‘ছলনাময়ী (১৯৩৭)’, ‘রসকলি (১৯৩৯)’, ‘হারানো সুর (১৯৪৫)’, ‘কালান্তর (১৯৫৬), ‘মিছিল (১৯৬৯)’, ‘উনিশশো একাত্তর (১৯৭১)’ ইত্যাদি। তাঁর রচিত অনেক উপন্যাস পেয়েছে চলচ্চিত্র রূপ, এদের মাঝে আছে ‘কালিন্দী’, ‘দুই পুরুষ’, ‘জলসাঘর’, ‘অভিযান’। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় উপন্যাস সমগ্র বাঙালি পাঠকের কাছে বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তাঁর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ‘শরতস্মৃতি পুরস্কার (১৯৪৭)’, ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক (১৯৫৬)’, ‘রবীন্দ্র পুরস্কার (১৯৫৫)’, ‘পদ্মশ্রী (১৯৬২)’, ‘পদ্মভূষণ (১৯৬৮)’ ইত্যাদি পুরস্কার ও উপাধি লাভ করেন। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় এর বই সমূহ মানুষের হৃদয়ে চিরস্থায়ী স্থান করে নিয়েছে। পাঠকনন্দিত এই বাঙালি কথাসাহিত্যিক ১৯৭১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পরলোকগমন করেন।