অন্যান্য ইউরোপীয় পর্যটকদের ভ্রমণবৃত্তান্ত থেকে তাভেরনিয়ের বিবরণ কিছু স্বতন্ত্র ও বিশিষ্টতা মণ্ডিত। আর এর ভালো-মন্দ দুদিকই আছে। তাভেরনিয়ের বৃত্তান্তে মধ্যযুগীয় বিশেষত মোগল যুগের ভারতবর্ষ ও এশিয়া খণ্ডের আরও অনেক স্থানের ভৌগোলিক পরিবেশ, দেশ-দেশান্তরের নামধাম, অবস্থান ও কৃষ্টি-সংস্কৃতির কথা বিবৃত হয়েছে বিশদভাবে। ভারতবর্ষের শহর, গ্রাম, রাস্তাঘাট, নদনদী ও জনজীবনের বর্ণনা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে। তাঁর বর্ণনায় এদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, মুদ্রা, শুল্কনীতি, বিনিময় প্রথা, পরিবহণ ব্যবস্থা, সামাজিক আচার-পদ্ধতি কিছুই বাদ পড়েনি। মোগল শাসননীতি, দরবার, সম্রাটের কর্মধারা, নবাব সুলতান ও সুবাদারগণের ক্রিয়াকলাপ, প্রাসাদ-দরবারের সম্রাটের কর্মধারা, নবাব সুলতান ও সুবাদারগণের ক্রিয়াকলাপ, প্রাসাদ-দরবারের বিচিত্ররূপ, এমনকি রাজপরিবারের খুঁটিনাটি বিষয় তিনি বর্ণনা করেছেন বিস্তৃতভাবে। কিন্তু সাধারণ জনসমাজ এবং ধর্মীয় ব্যাপারে, বিশেষত হিন্দুধর্ম ও মন্দিরাদির বর্ণনা-ব্যাখ্যানে তিনি কিছু অতিরঞ্জন ও অনভিজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন। যেমন ততীয় খণ্ডে রামায়ণের কাহিনি শুদ্ধ সত্য নয়, নানাভাবে ত্রুটিপূর্ণ। সম্ভবত বর্ণনাবৃত্তান্ত লেখার দিন পর্যন্ত সে বিবরণ স্মৃতিতে ধরে রাখতে পারেননি। পুরীর মন্দিরের অবস্থান নির্ভুল নয়। বারাণসীর মন্দির সম্বন্ধীয় তথ্যাদিও নির্ভরশীল নয়। মন্দির ও দেব-দেবীর মূর্তির নাম সঠিক লিপিবদ্ধ হয়নি। দেবমূর্তিরূপী রহস্য তিনি উপলব্ধি করতে পারেননি। বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে তাঁর উক্তিও অনভিজ্ঞতাজনিত এবং উপলব্ধিহীন অসার (৩য় ভাগ)। ভুটান রাজ্য সম্বন্ধীয় বিবরণ পরোক্ষভাবে সংগৃহীত। সুতরাং সব তথ্য সমকালীন বিষয়ের পূর্ণাঙ্গ ও সত্য বিবরণ কিনা তা জোর করে বলা যায় না। 'তিপরা' নামে যে রাজ্যটির কথা তিনি বলেছেন তার অবস্থান অস্পষ্ট। বর্তমান তিব্বত কিংবা ত্রিপুরা (ইংটিপেরা) রাজ্যের সঙ্গেও কোনো মিল-ভৌগোলিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রিক দিকে নেই। মোগল পরিবার ও প্রাসাদের অভ্যন্তর সম্বন্ধে তাঁর অভিজ্ঞতা মনে হয় পরোক্ষভাবে সংগৃহীত। বাস্তব সত্যের সঙ্গে পরিচয়ের অভাব হয়েছে প্রতিফলিত। তবে প্রাসাদের বহির্ভাগ, দরবার, মণি-মুক্তা, ধনসম্পদ, জাঁকজমক, ঐশ্বর্য ও উৎসবপর্ব সম্পর্কে যে বর্ণনা দিয়েছেন তাকে অবাস্তব মনে করার অবকাশ কম। কারণ তা বিদেশি পর্যটকদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাও আওতার মধ্যেই ছিল। তাভেরনিয়ে কেবল মোগল সম্রাট, দরবার ও রাজধানীর প্রতিই আকর্ষণ প্রকাশ করেননি। সমগ্র ভারতের প্রায় সব অঞ্চল, বিশেষত নবাব সুলতানের কর্মক্ষেত্র, বাণিজ্যক্ষেত্র, বন্দর-বাজার সর্বত্র বিচরণ করেছেন এবং তা বারংবার; তবে দাক্ষিণাত্য অঞ্চলই তাঁর ভ্রমণের অনেকখানি অংশ জুড়েছিল। গুজরাট, গোলকুণ্ডা, বিজাপুর, সুরাট, গোয়া, কোচিন, মসলিপত্তন, বুরহানপুর প্রভৃতি স্থানে যাতায়াত করেছেন তিনি সর্বাধিক। উত্তর ভারতে আগ্রা ও জাহানাবাদ তো মুখ্য কেন্দ্র হিসেবে তাঁকে টেনেছেঅবিরত। বাংলাদেশেও তাঁর আগমন হয়েছিল। সে বর্ণনা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাজাত। ভারত ভ্রমণ প্রসঙ্গে তিনি এশিয়ার অন্যান্য স্থানের বিশেষত পারস্য দেশের বর্ণনাও দিয়েছেন। আর তাতে অনেক কৌতূহলকর ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়।