জাতিসংঘে প্রথম নিয়োগ পেয়ে পশ্চিম আফ্রিকায় চাকরি করতে এসে অরোরার ডান হাতের মধ্যমায় লম্বা কাটা এক দাগ দেখে অরিত্র মানবিক আর্তিমাখা কী এক রহস্যের ইঙ্গিত পায়। তার পরবর্তী ঊর্ধ্বতন এই কর্তা অরোরার বিষণ আর ভেজা ভেজা পাপড়ি দিয়ে মোড়ানো বিস্ময়কর সৌন্দর্যের কাজল আঁকানো চোখ আর তার আঙুলের গভীর ক্ষতের কাটা দাগ দেখে কেন যেন অরিত্রের ছোটোবেলায় ‘মুভি অব দ্য উইক’-এ দেখা সাদা-কালো কোনো এক চলচ্চিত্রের এক দৃশ্যকল্পের কথা মনে পড়ে। আর অরোরা তার আঙুলের সামান্য এই কাটা দাগটুকুর মাঝে অরিত্র ব্যতীত অন্য কোনো মানুষের দ্বারা মানবিক কোনো আর্তিকে এভাবে শনাক্ত হতে কখনোই দেখেনি। অথচ দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে সেই দাগটুকু বয়ে বেড়ানোর পর অরিত্রের অন্তর্লোকে তা নিয়ে অপার আগ্রহ জাগায় সে বাঙালি এই তরুণের মনস্তত্ত¡, তার জীবনদর্শন নিয়ে স্বচ্ছ ধারণা পেতে তার এক বছরের ঊর্ধ্বতন সহকর্মী হয়েও বন্ধু হয়ে ওঠে। চৌদ্দ বছর আগের কৈশোরকে ভুলে যাওয়ার সাধনা রপ্ত করতে করতে অরোরা হারিয়ে ফেলেছিল নিজের শৈশবকে, তার আবেগি অনুভব অথবা ভালোবাসা ধারণকারী সত্তাকে। অরোরা শিকড়হীন এক বৃক্ষ হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশে বেড়াতে এসে অরিত্রের মা অরণির সান্নিধ্য আর স্নেহ-ভালোবাসায় ক্রমশ সে ফিরে পেতে শুরু করে তার হারিয়ে যাওয়া অতীতের স্বপ্ন আর অনুভবকে। শৈশব-কৈশোরের টুকরা টুকরা জীবনাল্লেখ্য নিয়েই সে হয়ে হয়ে উঠতে থাকে এক পরিপূর্ণ নারী। কিন্তু অরণির সাথে যুক্তি করে অরিত্রের মনোজগতের কাছাকাছি এসেও সে থেমে যায় তার অতীত স্মৃতির কারণে মনোজগতে চিরস্থায়ীভাবে আসন করে নেওয়া জনমানবহীন আফগানিস্তানের পাহাড়ি এক উপত্যকায়। তার সেইসব ভয়াল আর বীভৎস রাতগুলো। বাবাকে নিজের চোখের সামনে খুন হয়ে যাওয়া অথবা মা’কে টেনে হিঁচড়ে অজানার উদ্দেশে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য যতবার মনে পড়ে ততবার তার আত্মায় জেগে থাকা মরিয়মের সেই করুণ আর বিষণ স্বরটা বিশ্বের তাবৎ শিল্পীর সমবেত কণ্ঠে ধ্বনিত হতে থাকে। হিন্দুকুশ থেকে হিমালয় হয়ে আল্পস পর্বতের শৃঙ্গে। যেন পাখি, বৃক্ষলতা, রাতের ঝিঁঝি পোকা, ভ‚মির গহŸরে বাস করা সব কীট আর পতঙ্গ, জলের সব প্লাঙ্কটন সবাই এক পা কেটে নেওয়া এবং নিষ্ঠুর মানুষদের হাতে ধর্ষিতা মরিয়ম আর অরোরার মতো অগনিত কিশোরীর কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে স্রষ্টার কাছে নালিশের জন্য একই তানে নিনাদিত করে চলছে মহাবিশ্বের সকল প্রান্তর। অরিত্রকে নিবিড়ভাবে ভালোবাসতে চেয়েও অরোরা আঁতকে ওঠে আটকা পড়ে তার স্মৃতির ক্ষতের কাছে। তার আঙুলের দাগটুকুর কাছে এসে ‘ভালোবাসা’, ‘স্বপ্ন’ আর ‘কামনা’ শব্দগুলো কেমন মুখ ভেংচিয়ে তাকে উপহাস করে। ভালোবাসার পুরুষের কাছে নিজেকে অবারিত করতে আর কতকাল সময় নেবে অরোরা? নারী মনস্তত্তে¡ বাসা বাঁধা এক স্মৃতি-ক্ষত নিয়ে ঔপন্যাসিক তার দার্শনিক মুন্সিয়ানায় পরিশেষে গেঁথেছেন এমন এক প্রেমের গল্প যার পরতে পরতে ছড়ানো আছে প্রগাঢ় মমতা আর রহস্যময়তা। মানব-মানবীর প্রেমকে আড়াল করে, অরোরার মনস্তাত্তিকতা নিয়ে খেলতে খেলতে পরিশেষে মানুষের ভালোবাসার শক্তির জয়গান গাওয়ার এই অভিনব কৌশল কাজী রাফির গল্পকে ধারণের বিচিত্র আর ব্যপ্তিময় আরো এক অভিনবত্ব বৈ কি! কাজী রাফির লেখার বিষয়বস্তু উপন্যাস এবং ছোটোগল্প। প্রথম উপন্যাস ‘ধূসর স্বপ্নের সাসান্দ্রা’র জন্য পেয়েছেন ‘এইচ এস বি সি-কালি ও কলম পুরস্কার -১০’ এবং ‘এমএস ক্রিয়েশন সম্মাননা’। এছাড়াও উপন্যাস এবং ছোটোগল্পে অসামান্য অবদানের জন্য পেয়েছেন ‘নির্ণয় স্বর্ণপদক-১৩’ ।
কথাসাহিত্যিক কাজী রাফি ১৯৭৫ সালের ২২ নভেম্বর বগুড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম কাজী রইচ উদ্দীন এবং মাতার নাম ফিরোজা বেগম। তিনি ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ বগুড়া থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি থেকে গ্রাজুয়েশনসহ কমিশনপ্রাপ্ত হন । পরবর্তীতে তিনি নিজ ইংরেজিতে স্নাতক (সম্মান) সম্পন্ন করেন। ‘ধূসর স্বপ্নের সাসান্দ্রা’ উপন্যাস তার লেখা প্রথম উপন্যাস। প্রথম উপন্যাসেই তিনি পাঠক এবং বোদ্ধাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে ‘ধূসর স্বপ্নের সাসান্দ্রা’ , ‘ত্রিমোহিনী’ , রূপডাঙ্গার সন্ধানে’ , ‘পাসওয়ার্ড’ , ‘রংধনুর সাঁকো’, ‘লে জোঁ নদীর বাঁকে’, নিঃসঙ্গতার নগ্ন খোলস’, অরোরার আঙুল’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য । প্রথম উপন্যাস ‘ধূসর স্বপ্নের সাসান্দ্রা’র জন্য পেয়েছেন ‘এইচএসবিসি-কালি ও কলম পুরস্কার-১০’ এবং ‘এম এস ক্রিয়েশন (শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ) সম্মাননা’ । উপন্যাস এবং ছোটগল্পে অসামান্য অবদানের জন্য পেয়েছেন ‘নির্ণয় স্বর্ণপদক-২০১৩ ।