রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ জয়ী দেশটির জন্মের মূল উদ্দেশ্য ছিল, "আমাদের ফসলের সুষম বন্টন হবে আমাদের ধর্ম" এটাই মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিল। এই চেতনা আজ উহ্য হয়ে আছে। সুষম বন্টনের পরিবর্তে চলছে ক্ষমতার লড়াই। ক্ষমতার লড়াইটা যদি হতো, 'তোমার দ্বারা হচ্ছে না, আমি করবো' তাহলে কোন প্রশ্ন উঠতো না। ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে কারণ, ক্ষমতায় বসে একলা খাবা, তা হবে না তা হবে না। তুমি যদি দৈত্য হও, আমি হব মহাদানব। তুমি যদি চোর হও, আমি হব চোরের সর্দার। তুমি যদি চুরি কর, আমি ব্যাংক হজম করে ফেলবো। জনগণ! ওটা কেবলমাত্র একটি শব্দ। জনগণের উপর রাজনৈতিক দলগুলোর কেবলমাত্র বয়ান হয়। 'জনগণে বিশ্বাস' দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো কখনোই রাখেনি। বলছিলাম স্বাধীন বঙ্গভূমির কথা। অথচ খালি হাতের জনগণের উপর ভরসাই ছিল এই দেশটি স্বাধীন হবার মূলে। সীমিত সংস্করণ (Limited edition) and অফেরতযোগ্য (Non Refundable) শব্দ দুটো মূলত পণ্যের ক্ষেত্রেই বহুল ব্যবহৃত তবে এই শব্দ দুটো সমসাময়িককালে সমষ্টিগতভাবে আমাদের যুদ্ধ জয়ী স্বাধীন দেশটিতে কেন জানি সর্বত্রই দেখতে পাই (Not just in terms of goods)। বিশ্ব পুঁজিবাদের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশও একই পথের যাত্রী। যদিও যুদ্ধটা ছিল একান্তই আপন দর্শনের, আপন চাহিদার, আপন চাওয়া-পাওয়ার এবং দেশটি পুঁজিবাদের বাহিরে এসে সমাজতান্ত্রিক হবে। তবে আমরা সেই পথে পা মারাইনি দেশটির জন্মের পর থেকেই। বিশ্ব ব্রক্ষ্মাণ্ডের বাজার ব্যবস্থায় সীমিত সংস্করণ বিষয়টি সাধারণভাবে উচ্চবিত্ত বা অতি উচ্চবিত্তদের জন্য একপ্রকার গর্বের বা অতি মূল্যায়ীত পর্ব। বিশ্ব বর্তমানে পুঁজিবাদের জালে ঘেরা। এই পুঁজিবাদের চক্রে বাংলাদেশটিও নিমজ্জিত। সীমিত সংস্করণে অর্থের বিনিময়ে লোক দেখানোর একটি বিষয় বড় উপসর্গ। মানুষে মানুষে পার্থক্য স্পষ্টতই প্রতিয়মান হয় অর্থের দ্বারা যদিও আকার- আকৃতি বা দৈহিক গড়নে সব মানুষই একই এবং অভিন্ন । কালো- সাদা- বাদামি বাহিজ্যিক প্রকাশ তবে রক্তের মিল শতভাগ। বিশ্ব ব্রক্ষ্মাণ্ডের রক্ত- মাংসের মানুষগুলোর মাঝে যত গণ্ডগোল সেটা কালে কালে যুগে যুগে গড়ে উঠেছে কেবলমাত্র ক্ষমতাকে ঘিরে। লোভ- লালসা- চাওয়া-পাওয়া বা প্রভাব বিস্তার মূলত সেই আদি কাল থেকেই বা মানুষ জন্মের পর থেকেই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যর একটি। মানুষ জীবনের এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে যে বা যারা যতটা সংবরণ রাখতে সক্ষম হয়েছে, সেই সব মানুষগুলোই মৃলত মানুষের মাঝে নিজেকে ভিন্ন মাত্রায় উপস্থাপন করে মহামানব হয়ে সম্মান কামিয়েছে। মহামানবেরাও কোন এক সময় ছোট্ট শিশু থেকে ধীরে ধীরে জীবন চক্রের মধ্য দিয়েই মহামানবের রূপ লাভ করে থাকে। জন্ম সূত্রে কেউ যেমন চোর- ডাকাত- গুণ্ডা- বদমাশ হয়ে জন্মায় না, ঠিক তেমনটাই জন্ম সূত্রে কেউ মহামানব হয়ে আসে না। মানুষ তার আপন আচার- ব্যবহার আর কর্ম দ্বারাই মহামানব হয়ে উঠে। ঠিক তেমনটাই রাজনীতিবিদরাও মানুষের মাঝে পথে- ঘাটে থেকেই বেড়ে উঠে দিনে দিনে রাজনীতিবিদ হয়ে উঠে। এই বিশ্ব ব্রক্ষ্মাণ্ডের হাতেগুণে দুই একটি দেশ ব্যাতিরেকে সব দেশই রাজনীতিবিদদের দ্বারাই পরিচালিত হয়ে আসছে। বলাই বাহুল্য জনমানুষের সৌভাগ্য যে, বিশ্বের দেশগুলো রাজনীতিবিদদের দ্বারা পরিচালিত হয়। আমাদের এই স্বাধীন দেশটিও রাজনীতিবিদরাই পরিচালনা করেন। বায়ান্ন বছরের বাংলাদেশটিতে দুই তিনটি সময়কাল ব্যতিত মূলত রাজনীতিবিদদের দ্বারাই পরিচালিত হয়ে আসছে। ভোট- নির্বাচন- গণতন্ত্র- সমাজতন্ত্র- সাম্য- মানবাধিকার- মানবিকতা- শ্রমঅধিকার- আইনের শাসন, ধর্ম, বিদ্যা এবং সর্বপরি মানুষের জন্য/ দেশের জন্য বর্তমানে সব কিছুই Limited edition and Non Refundable. বিশ্ব ব্রক্ষ্মাণ্ডের সাথে আমরা তাল মিলিয়ে চলছি বটে তবে হিসেবের ক্ষেত্রে উদহারণ গ্রহণে সত্যিই আমরা সক্ষম নই বলেই প্রতিয়মান হচ্ছে। একটু কঠিন হলেও সত্য যে, স্বাধীন দেশের কথা পাশে রেখেই বলছি, তারও পূর্বে ৫৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে আজ অবধি আমাদের দেশে (পূর্ব পাকিস্তান ও বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশ) কখনোই কি ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়েছিলো ? যে ভোটটি নিয়ে কোন প্রশ্ন উঠেনি ? ৭০ এর নির্বাচনে ভোট নিয়ে প্রশ্ন না উঠলেও (অভিজ্ঞজনেরা বলতে পারবেন, উঠেছিল কিনা ?) ক্ষমতা হস্তান্তর হয়েছিল কি ? এই যে রাজনীতিতে এত জঞ্জাল। এত বাহাস ভোট নিয়ে। এত ভেজাল ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে। এত লোভ স্রেফ ক্ষমতা নিয়ে। এগুলোর সমাধান কিন্ত হয়েছিল। এমনকি লিখিত সমাধান হয়েছিল। স্মরণ করুন, স্বাধীন বাংলাদেশের দুইটি সামরিক শাসনের পরে ৯০ এর এরশাদ আন্দোলনের শেষ মূহূর্তে একটি চুক্তি হয়েছিল তিন জোটের (৭ দল/ ৮ দল/ ৫ দল) , লিখিত। তারও পরে এরশাদ পতনের পরে ওই তিন জোটের লিখিত চুক্তি হয়েছিল, " রাজনৈতিক আচরণ" কি হবে ? সেটাও লিখিত চুক্তি। নিশ্চয়ই সবার স্মরণে থাকার কথা। এবার ভেবে দেখুন, সব দল, আবার লিখছি সব দল কি সেই লিখিত চুক্তি ভঙ্গ করেনি ? ৯০ এর পরে এই যে নতুন গণতন্ত্রের যাত্রা বলি, সেটা সব দল কি ভঙ্গ করেনি ? এখন একদল আরেক দলের দিকে অঙ্গুলি প্রদর্শন করে, তুমিই সব দোষের মূল, তুমিই কেষ্টব্যাটা। তবে উপরের দিকে থুতু নিজেদের বুক ভিজিয়ে একাকার হয়, সেদিকে কারো নজর আছে কি ? সকল রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের থুতু কখনোই পরিষ্কার করেছেন কি ? তাহলে আশায় গুড়েবালি হবারই কথা নয় কি ? সেই আশার গুড়েবালিটাই মূলত এই স্বাধীন দেশ থেকে ভোট- গণতন্ত্র সার্বিক অর্থের উধাও। এই যে উধাও, ঠিক সেখানটায় সেই সীমিত সংস্করণ (Limited edition) and অফেরতযোগ্য (Non Refundable) শব্দদুটো কেন জানি বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠে। এর পিছনের কারণটি হলো, জনগণে বিশ্বাস না থাকা। বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলোর আপন লিখিত দর্শন যাই থাকুক কাগজে- কলমে, সেই দর্শনের বাহিরে এসে তারা ক্ষমতার চেয়ারকে সামনে রেখে জনগণকে সরাসরি পণ্য বানিয়ে ফেলেছে। লক্ষ্য করে থাকবেন, অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রমাণীত যে বারবার জনগণ রক্ত দিয়েছে। বারবার খুন- হত্যা- গুম এবং পৈশাচিক নির্যাতন- নিপিড়ণ আর অবহেলিত বারবার জনগণই হয়েছে। সেই জনগণকেই রাজনৈতিক দলগুলো আজ অবহেলা করে ওই ক্ষমতার লড়াইয়ে লিপ্ত। ফলাফল সব গেলো/ সব গেলো আর জাত গেলো/ জাত গেলোর মতন রাজনীতি গেলো। একটি রাষ্ট্রে যখন রাজনীতি চলে যায়, মানে রাজনীতি হারিয়ে যায়, সেই রাষ্ট্রে আর যাই হোক, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবার সুযোগ বারবার বঞ্চিত হয়। যা বর্তমান বাংলাদেশ। যে দেশটির জন্য এই জনপদের মানুষেরা এত রক্ত দিল, এত প্রাণ দিল, এত সম্ভ্রম দিল, সেই দেশটি আজ কেন এতটা বিপরীতমুখী চরিত্র ধারণ করলো ? এটা একটি বিশাল প্রশ্নের জন্ম দেয় নিশ্চয়ই। যে দেশটির জন্য ধর্ম- বর্ণ, কালো- সাদা নির্বিশেষে সবাই মিলে যুদ্ধ করলো, সেই দেশটিতে আজ আমরা ধর্মের নামে বিভক্ত। এমনকি বড় ধর্মের জনগোষ্ঠী আজ দেশটির জন্মসূত্র ভুলে গিয়ে একপাক্ষীক ধর্মের রাষ্ট্র বানাতে মরিয়া। মূলত এই বিপরীতমুখী সকল কর্মের মূলে সেই রাজনীতি। বলাই বাহুল্য রাজনীতি যতদিন তার আপন সহজ- সরল পথে ফিরতে না পারবে ততদিন দেশটির জন্মসূত্রে ফেরাটা হবে মুশকিল। ধর্ম- কর্ম- শিক্ষা- সমতা- মানবিকতা- সমাজ ব্যবস্থা- কৃষ্টি কালচার- নৈতিকতা- ঐতিহ্য সবকিছুই রাষ্ট্রের নীতির উপরেই নির্ভরশীল। সেই নীতিটা মূলত রাজনীতি। যাই লিখুন, যাই বলুন আর যাই করুন সবকিছুতেই রাজনীতি সামনে চলে আসবেই। রাষ্ট্র নিয়ে কথা বিনা রাজনীতিতে অসম্ভব। আমার এই বই "রাষ্ট্রের আলো- আঁধারে" রাষ্ট্রের নানান দিক, পজিটিভ- নেগেটিভ, নানান বিষয়, নানান অসমতা, নানান চিন্তাভাবনা কিংবা উপলব্ধি, এই সবই আমার আপন চোখে দেখা, আপন বুঝ, আপন বিশ্বাস এবং ভাবনার উপরে লেখা। আমি ব্যক্তিগতভাবে দার্শনিক ভালতেয়ারের দর্শন 'মত প্রকাশ' দর্শনটিকে সর্বদাই স্মরণে রাখি। মত প্রকাশ হতে দাও। সেই দর্শনেই আপন ক্ষুদ্র জ্ঞানে খোলা হৃদয়েই লেখা, " রাষ্ট্রের আলো- আঁধারে"।