বহুভাষাবিদ জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর পৌত্রী এবং ভাষাসৈনিক ও পঞ্চাশের দশকে কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতা কমরেড মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহর কন্যা শান্তা মারিয়া। ঢাকা শহরের এক অভিজাত পরিবারের মেয়ে হিসেবে শান্তা মারিয়া এমন অনেক গুণী ব্যক্তিকে দেখেছেন যাঁদের অবদান বাঙালি জাতির মুক্তি আন্দোলনে কিংবদন্তিতুল্য। দেখেছেন শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদের মতো সাহিত্য কিংবদন্তিদেরও। ২০২২ সালে ‘আমি বেগমবাজারের মেয়ে’ প্রকাশের পর পাঠকমহলে দারুণ জনপ্রিয়তা পায়। এরই ধারাবাহিকতায় লেখা হয় দ্বিতীয় খণ্ড। এখানে রয়েছে নব্বই দশকের গণআন্দোলন, বাংলা একাডেমির তরুণ লেখক প্রকল্পের কথা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস জীবনের গল্প। কোনো রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ নয়, বরং জীবনকে যেমন দেখেছেন ঠিক তেমনিভাবেই তুলে ধরেছেন তিনি। যারা বইটির প্রথম খণ্ড পড়েননি, তারাও দ্বিতীয় খণ্ড থেকে পুরোপুরি রস আস্বাদন করতে পারবেন। ‘আমি বেগমবাজারের মেয়ে’ দ্বিতীয় খণ্ড শুধু স্মৃতিগদ্য নয়। এটি বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে গড়ে ওঠা পুরনো জনপদ থেকে ঢাকার মহানগরী হয়ে ওঠার গল্প। সত্তর ও আশির দশকের শান্ত, নিরিবিলি ঢাকার গল্প, নব্বই দশকের নতুন ঢাকার গল্প। পুরনো ঢাকার ইতিহাস, ঐতিহ্য, রীতিনীতি যেমন এ লেখায় উঠে এসেছে তেমনি এসেছে নতুন ঢাকার নতুন জীবনের কথাও। শান্তা মারিয়ার ভাষা গতিশীল ও সরস। এ বই যেমন তথ্যসমৃদ্ধ তেমনি শিল্পঋদ্ধ। সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত এই লেখা নিঃসন্দেহে সংগ্রহে রাখার মতো।
শান্তা মারিয়া সাংবাদিক, চীন আন্তর্জাতিক বেতার। ২৪ এপ্রিল, ১৯৭০ ঢাকায় জন্ম। বাবা: কমরেড মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ, মা: ফয়জুননেসা খাতুন। শান্তা মারিয়া(ডাক নাম ভ্যালিয়া) তার জীবনের একেবারে শুরুতে আড়াই বছর থেকে বিটিভিতে রবীন্দ্রনাথের সোনার তরীসহ বিভিন্ন কবিতা আবৃত্তি করে খ্যাতি পান এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে প্রশংসা লাভ করেন। তিন বছর বয়স থেকে মুখে মুখে কবিতা লেখা শুরু। নয় বছর বয়সে প্রথম কিশোর কবিতার বই প্রকাশিত হয় ১৯৭৯ সালে। বইটির নাম মাধ্যাকর্ষণ। বইটি প্রকাশের পর জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কুর্ট ওয়াইল্ডহাইম, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ বিশ্বের অনেক দেশের খ্যাতনামা ব্যক্তিরা বইটির প্রশংসা করে চিঠি দেন। এরপর বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের শিশুদের পাতায় এবং সোভিয়েত নারী ও উদয়ন পত্রিকায় সাক্ষাৎকারসহ কবিতা প্রকাশ হয়। পরবর্তিকালে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের সাহিত্য পাতায় কবিতা প্রকাশ হয় নিয়মিত। ভারতের সন্দেশ ও যুগান্তর পত্রিকায় আশির দশকের শুরুতে শান্তা মারিয়ার কিশোর কবিতা প্রকাশিত হয়। বাংলা একাডেমির তরুণ লেখক প্রকল্প থেকে ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কবিতার বই। বইটির নাম সকল দোকান বন্ধ ছিল। বইটির প্রচ্ছদ করেছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী। এ পর্যন্ত ৫টি কবিতার বইসহ ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে গল্প ও প্রবন্ধ। কবিতার বইয়ের নাম ১. মাধ্যাকর্ষণ(১৯৭৯) ২. সকল দোকান বন্ধ ছিল (১৯৯৬) ৩. এবং একতারা বৃক্ষ (২০০০) ৪. আমরা বলে কোনো গল্প নেই (২০০৪) ৫. ওম মণি পদ্মে হুম( ২০১৭) অন্যান্য বই: চীনা সাহিত্যের আশ্চর্য ভুবন (২০২৪) আমি বেগমবাজারের মেয়ে (২০২২, স্মৃতিগদ্য)(দ্বিতীয় খণ্ড, ২০২৪) বিশ্বের সেরা রূপকথার গল্প প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড (১৯৯৬, সম্পাদিত), আকবর দ্য গ্রেট (মোগল ইতিহাসের গল্প, ১৯৯৬), জ্ঞানতাপস ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (কিশোরদের জন্য জীবনীগ্রন্থ, ২০০৫), সাহিত্যে পরকীয়া ও অন্যান্য (প্রবন্ধ সংকলন, ২০১৭), চকবাজার টু চায়না(ভ্রমণ গদ্য ২০১৭), চীনের মুসলিম চীনের মসজিদ(২০২৩) পলাতক জীবনের বাঁকে বাঁকে( কমরেড মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহর স্মৃতি গদ্য, অনুলিখন, ২০১৭)। সমুদ্র ও সাত মানবী (গল্প গ্রন্থ, প্রকাশিতব্য) লক্ষ্মণরেখার বাইরে (ভ্রমণ গদ্য, প্রকাশিতব্য) শিক্ষা: মেধাবী ছাত্রী শান্তা মারিয়া ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল ও কলেজ থেকে ১৯৮৬ সালে এসএসসি (প্রথম বিভাগ) এবং ১৯৮৮ সালে এইচ এসসি(প্রথম বিভাগ) পাশ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স। ভারত বিচিত্রা আযোজিত ‘মহাত্মা গান্ধী’ বিষয়ক রচনা প্রতিযোগিতায় এবং সোভিয়েত নারী পত্রিকা আযোজিত বিভিন্ন রচনা প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পান। এরপর বিভিন্ন সংগঠনের কাছ থেকে সম্মাননা ও পুরস্কার পেয়েছেন। পেশা: ১৯৯৭ সালে দৈনিক মুক্তকণ্ঠে সাংবাদিকতা শুরু। এরপর জনকণ্ঠ পত্রিকায় অপরাজিতা পাতার বিভাগীয় সম্পাদক ছিলেন ১০ বছর। আমাদের অর্থনীতিতে মফস্বল সম্পাদক, আমাদের সময়( অ্যাসিসটেন্ট এডিটর), রেডিও আমার(নিউজ এডিটর) ও চীন আন্তর্জাতিক বেতার( বিদেশী বিশেষজ্ঞ সাংবাদিক) এবং বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এ সিনিয়র সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন। সর্বশেষ আমাদের সময় পত্রিকায় ফিচার এডিটর পদে কর্মরত ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতায় নারী নেতৃত্ব বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। শান্তা মারিয়া চীনের ইউননান মিনজু বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন অনলাইনে কলামিস্ট। ২০২০ সালে যোগ দিয়েছেন চীন আন্তর্জাতিক বেতারের ঢাকা স্টেশনে। জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্য। পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোটসহ মানবাধিকার বিষয়ক বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সেমিনারে পেপার উপস্থাপন করেছেন। কবিতা, গল্প ও ভ্রমণকাহিনি প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পত্রিকায়। মানবাধিকারবিষয়ক লেখালেখিতে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। বিভিন্ন দেশী বিদেশী কবিতা উৎসবে অংশ নিয়েছেন। মঞ্চের জন্য নাটক লিখেছেন। জ্ঞানতাপস ভাষাবিদ ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহর পৌত্রী ও ভাষাসৈনিক এবং বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মী মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহর কন্যা এবং খান বাহাদুর আফাজউদ্দিন আহমেদ এর দৌহিত্রী। তার জীবনসঙ্গী সৈয়দ শাহিন রিজভি একজন কবি ও নাট্য নির্মাতা। এই দম্পতির একমাত্র সন্তান জুলকার সৈয়দ সামির অর্ণ বর্তমানে চীনের বিশ্ববিদ্যালয়ে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। ভ্রমণ করতে ভালোবাসেন। মিথোলজি ও ইতিহাসপাঠ শান্তা মারিয়ার প্রিয় নেশা।