২০২০ সাল। আমার জন্ম মাস আগস্ট। এই মাসের শুরুতেই মানে পহেলা আগস্ট রাত্রি বারোটা বেজে এক মিনিটে কবি ও গদ্যকার জাহিদুর রহিমের একটা ফেইসবুক পোস্টে মির্জা গালিবের লেখা আমার খুবই প্রিয় একটি শায়েরির অনুবাদ চোখে পড়ে: 'জান দি দি হুয়ি উসি কি থি/ হক তো ইয়ে হ্যায় কি হক আদা না হুয়া'। অনুবাদক বাঙলাদেশে উর্দুভাষা, সাহিত্য ও ইতিহাসের পণ্ডিত জাভেদ হুসেন। তাঁর অনুবাদ পড়ে আমি প্রাণিত ও অনুরণনিত হই। ফলে আমারও সেই শায়েরিটি ভাষান্তরের বাসনা জাগে প্রাণে, একটি অপ্রকাশ্য-সুন্দর কারণে। আর ওই পোস্টের মন্তব্যের ঘরেই তার ভাষান্তর আমি করি সঙ্গে সঙ্গেই। এটা ছিল আমার প্রথম গালিব অনুবাদ। ফলে জাভেদ হুসেনের প্রতি আমার সশ্রদ্ধ কৃতজ্ঞতা। জাভেদ হুসেন ছাড়াও দুই বাঙলায় আবু সয়ীদ আইয়ুব, মনিরউদ্দীন ইউসূফ, মণিমালা বসু, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, আয়ান রশিদ, মুস্তফা জামান আব্বাসী, সুতপা সেনগুপ্ত, পুষ্পিতা মুখোপাধ্যায়, দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, জ্যোতিভূষণ চাকী, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়, জয়দেব বসু, রাহুল পুরকায়স্থ, কমলেশ সেন, সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়, রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবোধ সরকার, কৃষ্ণা বসু, গৌরাঙ্গ গোপাল সেনগুপ্ত, বহ্নিশিখা ভট্টাচার্য্য, জাফর আলম, বুলবুল সরওয়ার, শ্রীজাত, শাকির এলাহী, ওবায়দুল্লাহ মনসুর, মাহমুদ আলম সৈকত প্রমুখের নানা ভাষান্তর আছে বাঙলায়। তাদের নিচে আমার মতো এই আনপড় অভাজনের কতিপয় ভাষান্তরও যুক্ত হল বলে সম্মানিত বোধ করছি। এইসব ভাষান্তর করতে গিয়ে বিপুল আনন্দ পেয়েছি, কখনো গালিবের কবিতার ভাবের ভিতর ডুব দিতে গিয়ে গভীর বেদনা বোধ করেছি, আমার দশদিশা মাইল মাইল হাহাকারে ছেয়ে গেছে। মূলত ইংরেজি নানা অনুবাদকে আশ্রয় করে এই ভাষান্তর করেছি। পাশাপাশি অন্যান্য বাঙলা-অনুবাদ সামনে রেখেছি। কৈশোরে খেলাচ্ছলে সামান্য উর্দু শিখেছিলাম। বলতে গেলে এখন সবটাই ভুলে গিয়েছি, লিখতে-পড়তে পারি না, তবে খানিকটা বুঝতে পারি। তা আমার এই ভাষান্তরকর্মে বেশ কাজ দিয়েছে। ফলে শুনে শুনে বোঝার চেষ্টা করেছি। কঠিন শব্দের অর্থ নানা সূত্রে যাচাই করেছি। সবচেয়ে বেশি সহায়তা নিয়েছি রেখতাডটকম নামের একটা ওয়েবসাইটের। আমি সরাসরি ফেইসবুক পোস্টেই অনুবাদের কাজটা করেছি। ফলে সংশিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ কতিপয় ভাই, বন্ধু, অগ্রজের মূল্যবান পরামর্শ পেয়েছি, যা কাজে লেগেছে। এই বইতে আমি গালিবের বিভিন্ন গজল থেকে ২০৩টি নির্বাচিত শায়েরির ভাষান্তর করেছি। দেখা গেছে শুনতে শুনতে একটা গজলের একটা শায়েরি আমাকে টান মারল আর ওটার ভাষান্তর করে ফেললাম। পরে একই গজল আবার শুনতে গিয়ে আরেকটা শায়েরি আমাকে গ্রাস করল, তখন আবার ওটা করলাম। এর মাঝখানে ঢুকে গেল আরো কিছু। তাই এইখানে একই গজল থেকে নেওয়া শায়েরির ওইঅর্থে কোনো ধারাবাহিকতা রাখিনি। বিচ্ছিন্নভাবে যখন যেটা করেছি ওভাবেই রেখেছি। শেষ হবার পর অনুজপ্রতিম লেখক, ডিজাইনার ও উর্দু ভাষার শিক্ষক তাইফ আদনান মূল শায়েরির উর্দু উচ্চারণগুলি মিলিয়ে দিয়েছেন। তাকে অনুরোধ করেছিলাম একদম শুদ্ধ হবার দরকার নাই, আমরা বাঙলাভাষীরা উর্দু শব্দগুলি শুনে যেইভাবে গ্রহণ করি আর বোঝার চেষ্টা করি, সেইভাবে মিলিয়ে দিলেই হবে। আদনান সেইভাবেই করেছেন। তার জন্য ভালোবাসা। শায়েরিগুলি সরাসরি ইংরেজি অনুবাদ থেকে ভাষান্তর করিনি, কারণ ইংরেজিটা অনেকটাই ভাবানুবাদ। এতে গালিবের মূল রস, আইরনি, সারকাজম অনেকক্ষেত্রে হারিয়ে যায় দেখেছি। আমি মূলানুগ থাকার চেষ্টা করেছি যতটা সম্ভব, যার অনুরণন গালিবের কাছাকাছি। তার তাল ধরার চেষ্টা করেছি। দুয়েক জায়গায় না পারতে ভাবের আশ্রয় নিয়েছি, না হয় মিলত না। আরো একটা বিষয় করছি, দুই লাইনে মাত্রা সমান রেখে অন্ত্যমিল রেখেছি। গালিব ছিলেন আমার একবারেই শৈশব-কৈশোরের প্রেম, গজলের কারণে। তাঁকে আরো জানতে পাই গুলজারের বানানো টিভি সিরিয়াল দেখে। নব্বই দশকে সেটা বিটিভিতে দেখানো হত। দীর্ঘদিন পর আবার গালিবকে পড়েছি, শুনেছি এইই আমার আনন্দ। গালিব আর উর্দু-সাহিত্য বিষয়ে পড়াশোনা করেছিলাম ১৯/২০ বছর আগে। আবার পড়াশোনা করার অনুপ্রেরণা পেয়েছি। গালিব ও তাঁর কবিতা সম্পর্কে যেহেতু অজস্র লেখাপত্র আছে পণ্ডিতদের লেখা, তাই আমি আর এইখানে কোনো পাণ্ডিত্য দেখালাম না। তবে একটা কথা না বললেই নয়, গালিব তাঁর কবিতার তেমন কোথাও সরাসরি কিছু বলেননি, ভাব ও ইঙ্গিতের ভাষায় কথা বলেছেন। তাই পাঠককেই মাথা খাটিয়ে বুঝে নিতে হবে। পাঠকের জন্যে রইল আমার আন্তরিক ভালোবাসা।